স্বপ্ন ছিল কলেজের শিক্ষক হওয়া!

রুহুল বয়ান, মহেশখালী, কক্সবাজার

ছোটবেলায় তাঁর স্বপ্ন ছিল পড়ালেখা করে কলেজের একজন শিক্ষক হবেন। দারিদ্র্য পরিবার হওয়ায় কোনোরকমে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করেন। কিন্তু ডিগ্রিতে ভর্তি হলেও টাকার অভাবে পরীক্ষা দিতে পারেননি তিনি। এ কারণে প্রতিভা থাকার পরও অসহায় পরিবারে জ নেওয়ায় তাঁর স্বপ্ন আলোর মুখ দেখেনি। শেষ পর্যন্ত অসহায় পরিবারের হাল ধরার জন্য প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিয়ে প্রথমবারেই সহকারী শিক্ষিকা হিসেবে উত্তীর্ণ হন মিতালী প্রভা দে।

মিতালী প্রভা দে কলেজশিক্ষক হতে না পারলেও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকই হয়েছেন। ছাত্রজীবনে যেমন ভালো করার তাগিদ ছিল, ঠিক তেমনই শিক্ষকজীবনেও তাঁর মেধা ও দক্ষতা দিয়ে চেষ্টা করেছেন সবচেয়ে ভালো করার। বিকেল চারটায় স্কুল ছুটির পর তাঁর সহকর্মীরা বাড়িতে ফিরে যেতেন। কিন্তু বাড়িতে ফিরে যাননি তিনি। স্কুল ছুটির পরও দ্বিতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বাড়তি সময় দিতেন মিতালী প্রভা দে। তাঁর উদ্দেশ্য একটাই—শিক্ষার্থীদের ভালো করে গড়ে তোলা। এমনকি নিজের মেয়েকে গুরুত্ব না দিয়ে অন্য শিক্ষার্থীদের প্রতি বাড়তি নজর থাকত তাঁর। ছুটির দিনেও বিশেষ পাঠদান দিয়ে শিক্ষার্থীদের মেধাবী করার চেষ্টা করে সময় কাটান মিতালী প্রভা দে।

মিতালী প্রভা দের জন্ম ১৯৭১ সালের ৬ জানুয়ারি কক্সবাজারের দ্বীপ উপজেলা মহেশখালীর হোয়ানক ইউনিয়নের কেরুনতলী হিন্দুপাড়া গ্রামে। হোয়ানক বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয় থেকে ১৯৮৬ সালে মানবিক বিভাগ থেকে এসএসসি ও মহেশখালী কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। তিনি। পরে রাউজান কলেজে ডিগ্রিতে ভর্তি হলেও টাকার অভাবে পরীক্ষা দিতে পারেননি তিনি। চার ভাই ও ছয় বোনের মধ্যে তিনি নবম। বাবা চন্দ্রমোহন দে পানখেত ও কৃষিকাজ করেই কোনোরকম সংসার চালাতেন। ছোটবেলা থেকে তাঁর স্বপ্ন ছিল কলেজের একজন শিক্ষিকাই হবেন। কিন্তু দারিদ্র্যের কারণে তার স্বপ্ন শুধু স্বপ্নই থেকে গেল। দারিদ্রা পরিবারে জন্ম নেওয়ায় কলেজে শিক্ষকতা করা তাঁর জন্য দুঃস্বপ্ন হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত কলেজশিক্ষক হতে না পারলেও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষকই হয়েছেন তিনি।

সহকারী শিক্ষিকা হিসেবে উত্তীর্ণ হওয়ার পর ১৯৯০ সালের ৫ নভেম্বর প্রথমে হোয়ানক বানিয়াকাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। এরপর টানা তিন বছর ওই বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন তিনি। এরপর ১৯৯৩ সালের ৩০ ডিসেম্বর বদলি হয়ে গোরকঘাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগ দেন তিনি। এরপর থেকে ওই বিদ্যালয়ে টানা ২৮ বছর ধরে সুনামের সঙ্গে শিক্ষকতা করে আসছেন তিনি। তাঁর স্বামী মাখন লাল দের ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পদে কর্মরত।

ওই বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, পঞ্চম শ্রেণিতে পাঠদান করছেন শিক্ষিক মিতালী প্রভা দে। তাঁর বিষয়ে জানতে চেয়েছিলাম সহকর্মী সহকারী শিক্ষিক রুমিশ্রী শীলের কাছ থেকে। তিনিও বললেন একই কথা। তিনি বললেন, চার বছর ধরে মিতালী প্রভা দের সঙ্গে একই বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে আসছে তিনি। মিতালী প্রভা দে ছাত্রছাত্রীদের প্রিয় শিক্ষক। তাঁর পাঠদানে মুগ্ধ শিক্ষার্থীরা। এ কারণে এলাকায় তাঁর সুনাম রয়েছে। একই কথা বললেন বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি এম আজিজুর রহমান। মিতালী প্রভা দে বলেন, ‘সহকারী শিক্ষিকা পদে উত্তীর্ণ হওয়ার পর টানা ৩১ বছর ধরে।

শিক্ষকতা করে আসছি।’ তাঁর হাতে গড়া অন্তত ৫০ শিক্ষার্থী সরকারের উচ্চপর্যায়ের বিভিন্ন পদে কর্মরত আছেন, জানালেন মিতালী প্রভা দে।

বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি এম আজিজুর রহমান বলেন, নিয়মিত স্কুলে আসা যাওয়ার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের ভালো পাঠদান করেন মিতালী প্রভা দে। এ ছাড়া ছোট্ট শিশুদের পড়ালেখার পাশাপাশি আদর করতেন তিনি। এমনকি কোনো শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে না এলে তার খোঁজ নিতেন তিনি।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী রেজিষ্ট্রার চিকিৎসক কানন সেন বলেন, “মিতালী প্রভা দে আমার শিক্ষিকা। তাঁর চোখে দেখা একজন ভালো শিক্ষিকা মিতালী প্রভা দে। ধরে শিক্ষকতা করায় এলাকার আশপাশের একজন প্রিয় শিক্ষক হিসেবে মিতালী প্রভা দে অনেক সুনাম কুড়িয়েছেন।

তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমের কারণে ১৯৯৭ সালের বৃত্তি পরীক্ষায় ওই বিদ্যালয় থেকে সাধারণ গ্রেডে বৃত্তি পান তিনি। এমনকি তাঁর পাঠদানে মুগ্ধ অন্য শিক্ষার্থীরাও। ফলে ওই বিদ্যালয়ে টানা ২৮ বছর ধরে শিক্ষকতা করায় এলাকার আশেপাশের একজন প্রিয় শিক্ষক হিসেবে মিতালী প্রভা দে অনেক সুনাম কুড়িয়েছেন।

Categories সম্মাননা ২০২১