স্কুল স্কুল খেলা থেকে ‘সেরা শিক্ষক’
আনোয়ার পারভেজ, বগুড়া
স্কুলে যাতায়াতের পথে প্রায়ই ইভ টিজিংয়ের শিকার হয়েছেন। বখাটেদের ভয়ে মাত্র ১৫ বছর বয়সে মা-বাবা বিয়ে দিয়ে দেন। বাল্যবিবাহের কারণে স্বপ্ন ভেঙে গেলেও হাল ছাড়েননি বগুড়ার শেরপুর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শাহনাজ পারভীন। ২০০৯-১০ সালে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচিত হন। ২০১৩ সালে জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ নারী শিক্ষকের পুরস্কার পেয়েছেন। ২০১৭ সালে ইউনেসকোর মনোনয়নে ভারকি ফাউন্ডেশনের গ্লোবাল টিচার পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন পান।
বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার দাড়িপাছা গ্রামে ১৯৭৬ সালের ১১ জানুয়ারি শিক্ষক পরিবারে জন্ম শাহনাজ পারভীনের। ছোটবেলা থেকেই শিক্ষক মা-বাবাকে দেখে মনে মনে শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। বিকেলে সঙ্গীরা যখন পুতুল নিয়ে সংসার পাতত, শাহনাজ তখন তাদের ডেকে ‘স্কুল স্কুল’ খেলতেন। সঙ্গীরাই হতো শিক্ষার্থী। আর হাতে বেত নিয়ে শিক্ষক সেজে তাদের পড়াতেন শাহনাজ। দুপুরে বৈঠকখানার সামনে কাল্পনিক ‘ছাত্র’কে নিজে মাস্টার সেজে “নামতা, ছড়া’ ইত্যাদি পড়াতেন। ছাত্রী হিসেবেও ছিলেন মেধাবী। প্রথম হওয়াটা যেন নিয়ম হয়ে গিয়েছিল। মায়ের কর্মস্থল বগুড়ার শেরপুরের উলিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ১৯৮৫ সালে পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি পান তিনি।
এরপর শেরপুর শহীদিয়া কামিল মাদ্রাসা থেকে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পান। পরে দাখিল পাস করেন। কিন্তু যাওয়া-আসার পথে বখাটেরা উত্ত্যক্ত করত তাকে। ফলে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। স্বামী একই উপজেলার সাধুবাড়ী গ্রামের মাদ্রাসাশিক্ষক মোহাম্মদ আলী। যৌথ পরিবারের বড় বউয়ের কাঁধে সব দায়িত্ব পড়ে। সংসারের রান্না, শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা, ননদ-দেবরের আদর-যত্ন সবকিছুই সামলান। সকালের রান্নাবান্না শেষে ক্লাসে যাওয়া আর বিকেলে ক্লাস থেকে ফিরে ফের রসুইঘরে। রাতে খাওয়াদাওয়ার পূর্ব শেষে রাত জেগে পড়া। ফলও পেলেন। ১৯৯২ সালে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড থেকে আলিম পরীক্ষায় মেধাতালিকায় সারা দেশে মেয়েদের মধ্যে দ্বিতীয় হন শাহনাজ। মেডিকেল কলেজ ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিলেও শ্বশুরবাড়ির আপত্তির কারণে বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে ভর্তি হোন। এ সময় কন্যাসন্তানের জন্ম। রাতে মেয়েকে দোলনায় শুইয়ে রেখে পড়াশোনা, সকালে মায়ের কাছে মেয়েকে রেখে কলেজ যাওয়া। স্নাতকে পড়ার সময়ই বেসরকারি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন তিনি। ২০০৩ সালে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। শিক্ষকতাকেই পেশা হিসেবে বেছে নিলেন। বিএড, এমএডসহ বিভিন্ন ডিগ্রি অর্জন করেন এবং প্রশিক্ষণ নেন। শেরপুর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগদানের পর থেকে ‘ভালো শিক্ষক হওয়াটাই ছিল ধ্যানজ্ঞান’। ঝরে পড়া রোধ করার পাশাপাশি পাঠদানকে আনন্দময় ও কোনো বিষয় সহজভাবে শিশুদের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করতেন তিনি।
“প্রতিদিন ভোরে দুই মেয়েকে স্কুলবাসে তুলে দিতে শেরপুর বাসষ্ট্যান্ডে আসতেন। ছোট সেলুন, চায়ের দোকান, হোটেলে কাজ করত শিশুরা। ২০১৩ সালে এ রকম দু-তিনজন শিশুকে বাড়িতে ডেকে এনে পড়ানো শুরু করলেন তিনি। দিন দিন শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়লে স্বামীর সহযোগিতায় একটা ঘর ভাড়া নিয়ে শেরপুর শিশুকল্যাণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু করেন। বেলা তিনটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত চলে এ স্কুলের পাঠদান। বর্তমানে এ স্কুলের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১১৭। শিক্ষার্থীরা কর্মজীবী, কয়েকজন শ্রবণ ও বাকপ্রতিবন্ধী।
একসময় টের পান অনেক শিশুই শিক্ষার মাঝপথে ঝরে পড়ছে। কারণ অনুসন্ধানে বাড়ি বাড়ি যাওয়া শুরু করেন। ২০১০ সালে বগুড়া, রংপুর ও ময়মনসিংহ জেলার প্রায় ৮০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর গবেষণা চালিয়ে দেখেন, বিনোদনের অভাব, বাল্যবিবাহ, দারিদ্র্য, বখাটের উৎপাত, শিশুশ্রম- এসব কারণে ঝরে পড়ছে শিশুরা। সে অনুযায়ী কাজ শুরু করেন। যোগদানের সময় শাহনাজের স্কুলে ঝরে পড়ার হার ছিল প্রায় ৪২ শতাংশ। এখন সেটি শূন্য শতাংশে নেমে এসেছে। শিখন শেখানোর গতানুগতিক পদ্ধতি বদলে আকর্ষণীয় উপকরণ, মাল্টিমিডিয়া ব্যবহার করে ডিজিটাল কন্টেন্টের মাধ্যমে পাঠ উপস্থাপন, সর্বোপরি প্রকৃতির সান্নিধ্যে শিশুদের নিয়ে খেলার ছলে শেখান তিনি। স্নেহপরায়ণ সদা হাস্যময় ও পরম আদরমাখা কথায় শিক্ষার্থীদের শুধু ভালো ছাত্রই নয় ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন তিনি। দেশে ও বিদেশে বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে এখন শিক্ষকদেরও প্রশিক্ষণ দেন। বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেন। কুচকাওয়াজ ও ডিসপ্লে প্রতিযোগিতায় উপজেলায় বরাবরই প্রথম স্থান অক্ষুণ্ণ রেখেছেন। শিশুদের নিয়মিত স্কাউটিং ও কাবিং কার্যক্রমের কারণে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে ১৪ জন শিক্ষার্থী শাপলা কাব অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছেন।
শিক্ষার্থী-অভিভাবকসহ সবার প্রিয় শিক্ষক শাহনাজ পারভীন। শিক্ষার্থীরা বাড়িতে কী কী করল, রাতে কারও মা-বাবা ঝগড়া করল সবাই এসব বিষয়ও এসে বলে। জেলা কিংবা বিভাগীয় পর্যায়ে কোনো প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে বাচ্চাদের নিয়ে যেতে হয়। ক্রীড়াশিক্ষক হিসেবে দায়িত্বটা শাহনাজের কাধেই পড়ে। কারও বাচ্চা অসুস্থ হলে রাত-বিরাতে শাহনাজকে ফোন করে পরামর্শ চান অভিভাবকেরা। কেউ অনুপস্থিত থাকলে তাদের খোঁজখবর নেন তিনি। অসুস্থ হলে ছুটে যান। শিক্ষকতার বাইরে লেখালেখিও করেন। তাঁর লেখা দুটি বই – শিশুদের জন্য ছড়ার বই, পাখির মুখে ফুলের হাসি (২০১৩), আর প্রাথমিক শিক্ষার হাল নিয়ে লেখা অনুসন্ধান (২০১০)।
শিক্ষকতার পাশাপাশি যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর কর্তৃক আয়োজিত সুস্থ ও অসহায় নারী ও যুবানের কর্মসংস্থানের জন্য বুটিক-বাটিক, নকশিকাঁথা ও সেলাইসহ বিভিন্নন্ন। প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়নবিষয়ক বিভিন্ন কার্যক্রম, সামাজিক-সাংস্কৃতিক কাজে অংশগ্রহণ করছেন। কমিউনিটি পুলিশিংয়ের (বিট পুলিশিং) সঙ্গে যুক্ত থেকে মাদক, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ গঠনে বিভিন্ন সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেছেন। হয়ে উঠেছেন সবার প্রিয় “শাহনাজ আপা”।