আলোর বাতিঘর

আনোয়ার পারবেজ, বগুড়া

দেশভাগের সময়ে ১৯৪৭ সালে বগুড়া শহর থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে নিশিন্দারা গ্রামে রক্ষণশীল পরিবারে জন্ম নেন রওশন আরা বেগম। বাবা আবদুর রাজ্জাক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, মা অবিরন বিবি গৃহিণী। চল্লিশের দশকে নারীশিক্ষার প্রতি সমাজ-পরিবারের একধরনের বাঁকা দৃষ্টি ছিল। মায়ের ইচ্ছায় পড়াশোনায় হাতেখড়ি নিশিন্দারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তখন এলাকায় কোনো মেয়েদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না থাকায় মা-বাবা একমাত্র মেয়েকে আর পড়াতে চাননি। কিন্তু রওশন আরার জেদের কাছে মা-বাবা হার মেনে বগুড়া শহরের ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল গার্লস স্কুলে (এখন সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়) রওশন আরাকে ভর্তি করে দেন। জেদের কারণে বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দূরের বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ায় বাবা টিফিনের টাকা কখনো দিতেন না। জোটেনি রিকশাভাড়াও। প্রতিদিন প্রায় ১২ কিলোমিটার পথ হেঁটে বাড়ি থেকে বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়া করতে হয়েছে। কিশোরী মেয়ের একা একা স্কুলে যাতায়াত পরিবারের অনেকে ভালোভাবে নেয়নি। শুরু হয় বিয়ের জন্য চাপ। কিন্তু পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর অদম্য জেদের কাছে অনড় থাকেন তিনি। শত বাধা, শত প্রতিকূলতার পাহাড় ডিঙিয়ে ১৯৬৩ সালে ওই বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। কিন্তু বিপত্তি বাধে কলেজে ভর্তিতে। ওই সময় বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজই ছিল এই অঞ্চলে উচ্চমাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার একমাত্র ভরসা। মেয়ে হয়ে ছেলেদের সঙ্গে এক কলেজে পড়াশোনা করবে, এটা কোনোভাবেই বাবা-মা মেনে নিতে রাজি নন। রওশন আরা সিদ্ধান্ত নেন, ঢাকার ইডেন কলেজে ভর্তি হবেন। কিন্তু দুর্গম পথ। কাঁচা সড়কপথে বগুড়া থেকে নগরবাড়িতে গিয়ে ফেরিতে চড়ে মানিকগঞ্জ হয়ে চারটি ফেরি পারাপার হয়ে রাজধানীতে পৌঁছাতে হতো। সকালে রওনা দিলে ঢাকায় পৌঁছাতে সন্ধ্যা হতো। মেয়ে হয়ে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে এত দূরের কলেজে পড়াশোনা করবেন, তাতেও রাজি করানো যায়নি পরিবারকে। কলেজে ভর্তিতে যখন চরম অনিশ্চয়তা ঠিক তখনই খবর আসে, বগুড়া শহরের ফুলবাড়ি এলাকায় ওই বছর প্রতিষ্ঠিত মুজিবুর রহমান মহিলা কলেজ (এখন সরকারি) শিক্ষার্থী ভর্তি করা হবে। অনেকটা স্বপ্ন ছোঁয়ার মতো সেই কলেজে ভর্তি হন রওশন আরা। প্রতিদিন বাড়ি থেকে ১৪ কিলোমিটার পথ হেঁটে কলেজে যাতায়াত করতেন। ১৯৬৫ সালে মুজিবুর রহমান কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। ওই বছর একই কলেজে স্নাতক কোর্স চালু হলে সেখানেই স্নাতকে ভর্তি হন রওশন আরা। বিয়ের চাপ এড়াতে ও নিজের পায়ে দাঁড়ানোর অদম্য ইচ্ছে থেকে ১৯৬৬ সালে বগুড়া শহরের রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় জুবিলী পৌর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৬৭ টাকা বেতনে শিক্ষকতা পেশায় যোগ দেন। ওই বছরের জুন মাসে পরিবারের ইচ্ছেতেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। স্বামী এ টি এম মীর আলম তখন রাষ্ট্রায়ত্ত বগুড়া স্পিনিং অ্যান্ড কটন মিলে চাকরি করতেন। বিয়ের পর ১৮৬৭ সালে বগুড়া সিটি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক পদে যোগ দেন তিনি। স্বামী, সংসার, শিক্ষকতার পাশাপাশি পড়াশোনা করেও ১৯৬৮ সালে মুজিবুর রহমান মহিলা কলেজ, থেকে স্নাতক পাস করেন। ১৯৭০ সালে রাজশাহী টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে বিএড পাস করেন। এর মধ্যে যে স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করেছেন, সেই সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে ১৯৭৪ সালে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। তারও দুই বছর আগে ১৯৭২ সালে কন্যাসন্তানের মা হন রওশন আরা। একসঙ্গে সন্তান লালন, স্বামী-সংসার ও চাকরি সামলানোর পরও ১৯৭৬ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে বাংলায় স্নাতকোত্তর পাস করেন। টানা ২৬ বছর একই প্রতিষ্ঠানে জ্ঞানের আলো ছড়িয়েছেন তিনি। তবে শুধু শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের দৈনন্দিন দায়িত্ব পালনের মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ থাকেননি।

শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের পাশাপাশি নেতৃত্ব দিয়েছেন স্কাউট, গার্লস ইন গাইড এবং রেড ক্রিসেন্টে। পাঠদানের বাইরে শিক্ষার্থীদের নানা সৃজনশীল কাজে ব্যস্ত রেখেছেন। বন্যা, মহামারিতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে মানবিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছেন। গরিব ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের ব্যক্তি উদ্যোগে বৃত্তি প্রদান করেছেন। পোশাক ও বই কিনে দিয়েছেন। বিনা পয়সায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে পড়িয়েছেন। দুর্বল ও অমনোযোগী শিক্ষার্থীদের পাঠে মনোযোগী করে তোলার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। বাল্যবিবাহের খবর পেলেই শিক্ষার্থীর বাড়িতে ছুটে গেছেন, ঝরে পড়া থেকে ছাত্রীদের রক্ষা করেছেন। বয়ঃসন্ধিকালে ছাত্রীদের সমস্যার সমাধানে বন্ধুর মতো পাশে থেকেছেন। আবার প্রয়োজনমতো কড়া শাসনও করেছেন।

দীর্ঘ শিক্ষকজীবনে ছাত্রী-অভিভাবকদের প্রশংসা অর্জন করেছেন। ২০০০ সালে সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে বগুড়া জিলা স্কুলে বদলি হন রওশন আরা। ২০০৪ সালে ৩৮ বছরের শিক্ষকতা জীবনের ইতি টানেন। তবে বিদ্যালয়ে আনুষ্ঠানিক পাঠদানের ইতি টানলেও আলো ছাড়ানোর পেশা ছাড়েননি রওশন আরা। ২০১৭ সালে নিজের বাড়িতেই সুবিধাবঞ্চিত এতিম শিশুদের জন্য খুলেছেন ‘সাফল্য শিশু পরিবার’ নামে একটি আবাসিক বিদ্যালয়। তিনি ছাড়াও চারজন শিক্ষক সেখানে পাঠদান করছেন। তিন বেলা খাবার, পোশাক, বই-খাতা সবকিছু বিনা মূল্যে পাচ্ছে শিশুরা। প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ছে এখানকার শিশুরা। প্রতিষ্ঠা করেছেন। নাজমুস সাকিব ফাউন্ডেশন। এই ফাউন্ডেশন থেকে ১০ জন শিক্ষার্থী বৃত্তি পেয়ে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও বিদ্যালয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে অধ্যয়ন করছে। এ ছাড়া ফাউন্ডেশন থেকে চিকিৎসা এবং বয়ত ও বিধবা ভাতাও দেওয়া হয়।

Categories সম্মাননা ২০২১