শারীরিক অক্ষমতা দমাতে পারেনি তাঁকে
এজাজ আহম্মেদ, রাজবাড়ী
তিনি শারীরিক প্রতিবন্ধী। এক পায়ে শক্তি পান না। এখন বয়সের কারণে হাঁটাচলা করতেও পারেন না। তাঁর চলার সঙ্গী ভ্যান বা হুইলচেয়ার। কিন্তু সময়মতো বিদ্যালয়ে উপস্থিত হওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর জুড়ি নেই। তিনি কখনো সকাল ১০টার পরে বিদ্যালয়ে আসেন না। আবার বিকেল চারটার আগে কখনো বিদ্যালয় থেকে বের হন না। পুরো নাম মো. ছিদ্দিকুর রহমান। ছিদ্দিক স্যার বলে পরিচিত। তিনি বালিয়াকান্দি উপজেলার নবাবপুর ইউনিয়নে ইন্দুরদী উচ্চবিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছেন।
দাম্পত্য জীবনে এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক। তাঁর বয়স যখন ৪ বা ৫ তখন তিনি পোলিওতে আক্রান্ত হন। পোলিও সেরে গেলেও তাঁর একটি পা অকেজো হয়ে যায়। চার ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়।
১৯৭০ সালে তিনি যখন দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী তখন তাঁর বাবা মারা যান। এরপরই সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটন। চাচার বাড়িতে থেকে পড়ালেখা করতেন। ইন্দুরদী উচ্চবিদ্যালয় থেকে অষ্টম শ্রেণি পাস করেন। তখন বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান করা হতো। এরপর ১৯৮০ সালে বালিয়াকান্দি পাইলট উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। দুই বছর পরে ১৯৮২ সালে পাংশা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণিতে পড়ার সময় তাঁর মা মারা যান। পাংশা কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে ইন্দুবাদী উচ্চবিদ্যালয়ে যোগদান করেন। তিন বছর স্বেচ্ছাশ্রম দেওয়ার পর তিনি এমপিওভুক্ত হন। ইন্দুরনী উচ্চবিদ্যালয়টি ১৯৩৫ সালে স্থাপিত। ২ একর ৩৫ শতক জমির ওপর নিরিবিলি। পরিবেশে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করা হয়। সাড়ে তিন শ শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক আছেন ১৪ জন। কর্মচারী চারজন। সর্বশেষ এসএসসি পরীক্ষায় ৯৭ শতাংশ পরীক্ষার্থী কৃতকার্য হয়েছে। মো. ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘আমি স্কুলে পড়ার সময় স্যাররা বলতেন, সময়ানুবর্তিতা একটি বড় গুণ। আমি ছোটবেলা থেকে সময়ের বিষয়ে সচেতন থাকতাম। এ কারণে স্কুলে চাকরি পাওয়ার পরও সব সময় সময় ঠিক রাখার চেষ্টা করেছি। কথা দিয়ে তা রাখার চেষ্টা করেছি। এ কারণেই ঝড়-বৃষ্টি যা-ই থাকুক না কেন আমি সময়মতো স্কুলে আসার চেষ্টা করেছি। আর ভবিষ্যতে আরও যত দিন চাকরি আছে, তা মেনে চলার চেষ্টা করব।’
সহকারী শিক্ষক মনিকা বিশ্বাস বলেন, ‘অনেক সময় আমরা বিদ্যালয় থেকে আগে চলে যাই। কখনো অন্য কোনো কাজের কারণে বিদ্যালয়ে থাকতে পারি না। তখন আমরা ছিদ্দিক স্যারকে স্কুলে রেখে যাই। তিনি ঠিক ৪টা পর্যন্ত স্কুলে থাকেন। কখনো আমাদের হিংসা করেন না, বা তাঁকে। বসিয়ে রেখে চলে গেলাম এ কারণে মন খারাপ করেন না। এ রকম স্যারের কোনো তুলনা হয়। না। তিনি সবার জন্য অনুসরণীয়।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আনিসুজ্জামান বলেন, ‘আমি বিদ্যালয়ের যোগ দেওয়ার পর থেকে তাঁকে কখনো দেরিতে স্কুলে আসতে দেখি নাই। শুধু তা-ই নয়, তিনি ছুটিও নেন না। তাঁর মতো শিক্ষক পাওয়াও ভাগ্যের ব্যাপার। শারীরিক সমস্যা তাঁকে দমাতে পারেনি। তিনি তাঁর নির্ধারিত বিষয় ছাড়াও ইংরেজি বিষয়েরও পাঠদান করেন। আবহাওয়ার কারণে দু-একজন শিক্ষার্থী ক্লাসে উপস্থিত থাকলেও তিনি আগ্রহসহকারে তাদের শ্রেণিপাঠ সম্পন্ন করেন।