![](http://www.priyoshikkhok.com/wp-content/uploads/2022/09/োি্.png)
জ্ঞানের ফেরিওয়ালা
মাহবুবুর রহমান, নোয়াখালী
১৯৬৭ সালে স্নাতক পরীক্ষা শেষে পার্শ্ববর্তী উপজেলার ছাতারপাইয়া উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। প্রধান শিক্ষক তাঁকে শিক্ষকতার প্রস্তাব দিলে পরদিনই তিনি ওই বিদ্যালয়ে পাঠদান শুরু করেন। এরপর শিক্ষকতার মাধ্যমে জ্ঞানের ফেরি করেন একে একে আরও চারটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। এর মধ্যে প্রধান শিক্ষকই ছিলেন দীর্ঘ ২৫ বছর।
শিক্ষকতাজীবনের বেশির ভাগ সময় নিজের আলোয় আলোকিত করেছেন অজপাড়াগাঁয়ের অবহেলিত সেই প্রতিষ্ঠানকে। তাঁর শিক্ষার্থীরা দেশ-বিদেশে নানা ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত। জ্ঞানের আলো বিলিয়েছেন অকাতরে, ক্লান্তিহীন। কখনো কোনো ধরনের অসুস্থতা তাঁকে কাবু করতে পারেনি। বিদ্যালয়ের অফিসকক্ষই ছিল ঘরবাড়ির মতো। যার কারণে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটি সবার কাছেই তিনি ছিলেন আপনজন।
নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলার আমিশাপাড়া ইউনিয়নের খলিলুর রহমান উচ্চবিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আবুল কালাম আজাদ সবার কাছে ‘কালাম স্যার’ নামেই পরিচিত। সম্প্রতি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দপ্তরেই কথা হয় এই গুণী শিক্ষাগুরুর সঙ্গে। অবসরের এক যুগের বেশি সময় পর ‘কালাম স্যার’ বিদ্যালয়ে আসবেন শুনে বিদ্যালয় আঙিনায় সেদিন জড়ো হন প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা। তাদের দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন প্রবীণ শিক্ষক আবুল কালাম আজাদও। বুকে জড়িয়ে ধরে ধরে স্নেহের পরশে আলিঙ্গন করেন প্রিয় ছাত্রদের সঙ্গে। নিজের শিক্ষকতাজীবনের শুরুর দিকের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে আবুল কালাম আজাদ বলেন, ১৯৬৭ সালের মে-জুন মাসে ছাতারপাইয়া উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষকতা দিয়েই তাঁর শিক্ষকতাজীবন শুরু। এরপর বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্রমশ তাঁর ভক্ত হয়ে ওঠে। পরের কয়েক বছর তিনি ওই বিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় পার করে দেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, ১৯৭২ সালে তিনি সোনাইমুড়ী উপজেলার (তৎকালীন বেগমগঞ্জ) নদনা ইউনিয়নের বাংলাবাজারের বঙ্গবন্ধু উচ্চবিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। প্রধান শিক্ষক থাকাকালে কুমিল্লায় গিয়ে বিএড কোর্স সম্পন্ন করেন। বঙ্গবন্ধু উচ্চবিদ্যালনো চাকরি করেন ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত। সেখান থেকে সোনাইমুড়ী কলেজের অধ্যক্ষ আবদুল ওহাব চৌধুরী ৩ ছাতারপাইয়া উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুর রহমান তাকে ১৯৭৫ সালের শেষ দিকে বেগমগঞ্জের মীর কাশেম উচ্চবিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করান। টানা সাত বছর চাকরি করেন ওই বিদ্যালয়ে।
তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৯৮১ সালে মীর কাশেম উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্র শেখ হাসানুর রহমান কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডে ১১তম স্থান লাভ করার গৌরব অর্জন করেন। এ ছাড়া তিনি যোগদানের পর থেকে পরবর্তী বছরগুলোতে মীর কাশেম উচ্চবিদ্যালয়ের ভালো ফলাফল ছিল সবারই নজরে। এ কারণে খলিলুর রহমান উচ্চবিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতার ছেলে আবদুল আউয়াল তাঁকে অনুরোধ করেন তাঁদের বিদ্যালয়ের দায়িত্ব নিতে। ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ওই বিদ্যালয় থেকে কোনো শিক্ষার্থী প্রথম বিভাগে পাস করতে পারেনি শোনার পর তিনি নিষেধ করতে পারেননি।
১৯৮৩ সালের জুন মাসে তিনি খলিলুর রহমান উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। দুই বছরের মধ্যে প্রথম বিভাগ পাওয়ার উপযুক্ত শিক্ষার্থী গড়ে তোলার লক্ষ্য ‘৮৪-৮৫ সালে কোনো টাকা ছাড়াই অষ্টম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য ছাত্রাবাসের এবং কোচিং ক্লাসের ব্যবস্থা করেন। যোগদানের তৃতীয় বছরেই এসএসসিতে তিনজন প্রথম বিভাগে পাস করে। এ ছাড়া একই অষ্টম শ্রেণি থেকে দুজন ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পায়। সেই থেকে খলিলুর রহমান উচ্চবিদ্যালয়ের ঈর্ষণীয় ফল ছিল সবার মুখে মুখে। ভালো ফল দেখে দূরদূরান্ত থেকে অনেক শিক্ষার্থী এসে ভর্তি হয়ে স্কুলের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৫০ থেকে বেড়ে পাঁচ শতে পৌঁছায়।
বিদ্যালয়ের আঙিনায় বাসস্থানের ব্যবস্থা থাকলেও তাঁর বেশির ভাগ সময় কাটত বিদ্যালয়ের অফিসকক্ষে। প্রিয় শিক্ষার্থীদের উন্নতি ঘিরেই তাঁর যত চিন্তা। যেসব শিক্ষার্থীর আর্থিক অবস্থা খারাপ তাদের আর্থিক সাহায্যের ব্যবস্থা করতেন। তিনি জানান, যোগদানের পর কবির নামের এক শিক্ষার্থীর দেখা পান। যাকে দুষ্টুমির কারণে কোনো শিক্ষকই ভালো চোখে দেখতেন না। একদিন তিনি তাকে কাছে ডেকে নিয়ে কথা বলেন, নানা পরামর্শ ও উপদেশ দেন। সেটি যেন মন্ত্রের মতো কাজ দেয়। অল্প দিনেই পড়ালেখায় মনোযোগী ও মেধাবীদের কাতারে চলে আসে কবির। ২০০৮ সালে খলিলুর রহমান উচ্চবিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করে গ্রামের বাড়ি একই উপজেলার চাষীরহাট ইউনিয়নে ফিরে যান আবুল কালাম আজাদ। কিন্তু এলাকার মানুষজন আবদার নিয়ে আসেন, সদ্য প্রতিষ্ঠিত স্থানীয় হনুফা খাতুন উচ্চবিদ্যালয়ের দায়িত্ব নিতে। শেষমেশ সেখানেও প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে দুই বছরের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির এমপিওভুক্তিসহ সবকিছু গুছিয়ে দিয়ে দীর্ঘ শিক্ষকতাজীবনকে বিদায় জানান তিনি। চার ছেলের সবাই পড়ালেখা শেষ করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। বর্তমানে বাড়িতে পরিবার ও আর নাতিপুতিদের সঙ্গে আনন্দের সময় কেটে যাচ্ছে এই জ্ঞানের ফেরিওয়ালার।
প্রিয় শিক্ষক আবুল কালাম সম্পর্কে বলতে গিয়ে ছাত্র মোহাম্মদ সফিকুল আলম বলেন, ইংরেজি বিষয়ে আবুল কালাম আজাদ স্যারের ছিল অসাধারণ দখল। ক্লাসে কোনো দিন তাঁর বই লাগত না। ইংরেজির যত বিষয় আছে, সবই তিনি চোখ বন্ধ করে অনর্গল বলতে পারতেন। স্কুলের ভালোর জন্য সব সময় চেষ্টা ও পরিশ্রম করতেন। তিনি ধনী-দরিদ্র সব ছাত্রছাত্রীকে সমান দৃষ্টিতে দেখতেন।
আরেক ছাত্র মো. আলমগীর (বর্তমানে একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক) বলেন, ‘কালাম স্যারের নিজের সন্তানের চেয়েও বেশি গুরুত্বের ছিল খলিলুর রহমান উচ্চবিদ্যালয়। কখনো নিজের সন্তান, অসুস্থ হলে, তার চিকিৎসায় গুরুত্ব দেওয়ার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতেন প্রিয় ছাত্রদের। আমাদের জীবনের মত ভালো অর্জন তার সবকিছুই সম্ভব হয়েছে কালাম স্যারের জন্য। খলিলুর রহমান উচ্চবিদ্যালয়ের বর্তমান প্রধান শিক্ষক মফিজুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, ‘এই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক হিসেবে আমার নিয়োগ হয়েছে কালাম স্যারের হাতে। প্রতিষ্ঠান পরিচালনার সবকিছুই শিখেছি স্যারের কাছ থেকে। তিনি যেভাবে গড়ে গেছেন, তার ধারাবাহিকতা রক্ষা করার চেষ্টা করে যাচ্ছি।’