একজন ‘গ্রাম্য স্যারের’ গল্প
শেখ আল এহসান, খুলনা
সুন্দরবন উপকূলের নদীর পাশের একটি গ্রাম ঘুগরাকাটী। ওই গ্রামের ভালো ছাত্র হিসেবে পরিচিত ছিলেন মো. আজিজুল হক। তাঁর বাবা ছিলেন দিনমজুর। পরিবারের পক্ষ থেকে আজিজুলকে পড়াশোনা করানোর ইচ্ছা ছিল না। বাবা চাইতেন তাঁর সঙ্গে মাঠে কাজ করাতে নিয়ে যেতে। কিন্তু শাহাবুদ্দীন মাষ্টারের চাপে পড়াশোনা চালিয়ে যান আজিজুল হক।
২০০০ সালে পঞ্চম শ্রেণির বৃত্তি পরীক্ষার সময় জামাকাপড় ছিল না আজিজুলের। তাই শাহাবুদ্দীন স্যার ঘুগরাকাটী বাজারের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা তুলে আজিজুলের জন্য জামাকাপড় ও জুতা কেনার ব্যবস্থা করেন। বৃত্তি পেয়েছিলেন আজিজুল। খুলনা সরকারি বিএল কলেজ থেকে ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর শেষ করে এখন কয়রা সদর উপজেলার একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করছেন। আজিজুল হক বলেন, শাহাবুদ্দীন স্যার না থাকলে হয়তো পড়াশোনা করতে পারতাম না।
তাঁর এমন মহানুভবতা গ্রামের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে। জীবনের শেষ বয়সেও প্রতিটি মানুষের নিয়মিত খোঁজখবর রাখার চেষ্টা করেন শাহাবুদ্দীন স্যার।
যে কাউকে শাহাবুদ্দীন মাস্টারের কথা জিজ্ঞাসা করলেই সবার আগে যে প্রশ্নটি শুনতে হয় তা হলো ‘ও, গ্রামের স্যার?’ সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেই মিলবে তাঁর বাড়ির ঠিকানা। প্রায় দুই যুগ আগে শিক্ষকতা শেষ করেছেন, কিন্তু তার রেশ এখনো রয়ে গেছে। মানুষের অন্তরে জায়গা করে নেওয়া ছোট-বড় সবাই এখনো তাঁকে সম্মান করেন, ভালোবাসেন। যেকোনো প্রয়োজনে ছুটে যান তাঁর কাছে।
আর কেনই-বা হবে না! তিনি ছিলেন একজন অনন্যসাধারণ শিক্ষক। শিক্ষকতাকে ভালোবাসতেন। সুন্দরবনঘেঁষা উপকূলবর্তী ওই এলাকায় শিক্ষাবিস্তারে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছেলেমেয়েদের ডেকে নিয়ে আসতেন স্কুলে। কোনো অভিভাবক বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাতে না চাইলে তিনি জোর করে নিয়ে আসতেন। ছোট বাচ্চাদের পরম মমতায় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করাতেন। নিজের পকেটের টাকা দিয়ে খাবার কিনে দিতেন। পায়খানা-প্রস্রাব করলে নিজ হাতে পরিষ্কার করতেন। নিজ হাতে স্কুল ঝাড়ু দিতেন। টয়লেট পরিষ্কার করতেন। ছেলেমেয়েদের হাত-পায়ের নখ ও চুল কেটে দিতেন।
টাকার অভাবে যেসব শিক্ষার্থীর পড়াশোনা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হতো তাঁদের সহায়তায়, এগিয়ে আসতেন শাহাবুদ্দীন স্যার। নিজের পকেট থেকে টাকা দেওয়ার পাশাপাশি অন্যের কাছেও হাত পাততেন ওই শিক্ষার্থীর জন্য। তাঁর সাহায্য পাওয়া এমন অনেকেই এখন বেশ প্রতিষ্ঠিত। এই গ্রামের স্যারের ৮৩ বছর বয়সের ৩৫ বছরই কেটেছে শিক্ষকতা পেশায়। পুরো নাম এস এম শাহাবুদ্দীন। এলাকার মানুষ তাঁকে গ্রামের স্যার নামে ডাকতেই বেশি পছন্দ করেন। বাড়ি খুলনার কয়রা উপজেলার বাগালী ইউনিয়নের ইসলামকাটি গ্রামে। বাবার বাড়ি পাশের ঘুগরাকাটী গ্রামে। কয়েক বছর আগে ইসলামকাটি গ্রামে বাড়ি করেছেন। চাকরি করতেন ঘুগরাকাটী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে। ১৯৯৮ সালের ১ মে চাকরি থেকে অবসরে গিয়েছেন তিনি।
মুগরাকাটী গ্রামটি খুলনা জেলা সদর থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত। বর্তমানে ওই গ্রামে যাওয়ার সড়কপথটিও খুব বেশি ভালো নয়। আর ওই শিক্ষক যখন শিক্ষকতা করতেন তখন গ্রামের প্রতিটি রাস্তাই ছিল মাটির। ছিল না বিদ্যুৎও। বর্তমানে ওই গ্রামের অধিকাংশ মানুষই দিনমজুর। মানুষের আর্থিক অবস্থাও খুব বেশি ভালো নয়। এমন একটি গ্রামে শিক্ষার আলো ছড়িয়েছেন শাহাবুদ্দীন স্যার।
বর্তমান প্রজন্মের অধিকাংশই তাঁর ছাত্র। বর্তমানে ওই গ্রামে যাঁরা শিক্ষিত ব্যক্তি রয়েছেন, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন, তাঁদের অধিকাংশের শিক্ষার পেছনে এস এম শাহাবুদ্দিনের অবদান রয়েছে।
এসব কেন করতেন—জানতে চাইলে হাসি দিয়ে শাহাবুদ্দীন স্যার বলেন, ‘গ্রামের স্কুলে বাচ্চাদের পড়াশোনা করানো বেশ কঠিন। ওই সময় অভিভাবকেরা বাচ্চাদের পড়াশোনার প্রতিও তেমন উৎসাহী ছিলেন না। তাই বাচ্চাদের স্কুলে পাঠানোর তাড়া ছিল না। এ জন্যই বাড়ি বাড়ি গিয়ে বাচ্চাদের স্কুলে ডেকে নিয়ে আসতাম।’ তিনি বলেন, ‘বাচ্চাদের সহানুভূতি না দিলে, কাছে টেনে না নিলে বাচ্চারা স্কুলে থাকবে না। বাচ্চাদের স্কুলের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি করতে তাদের নিয়ে বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলারও আয়োজন করতাম। তাদের সঙ্গে মিশে গিয়ে খেলতাম। এসব কারণেই বাচ্চারা স্কুলে আসতে আগ্রহী হতো।’
বর্তমানে শিক্ষকেরা সেই শিক্ষকতা পেশাটাকে হারিয়ে ফেলেছেন বলে মনে করেন শাহাবুদ্দীন স্যার। তাঁর মতে, শিক্ষকেরা এখন ছুটছেন টাকার পেছনে। স্কুলে পড়ানোর চেয়ে প্রাইভেট পড়ানোকেই এখন বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। এ কারণে দিন দিন শিক্ষকেরা মানুষের কাছে উপহাসের পাত্র হয়ে যাচ্ছেন। নিজের প্রাপ্তি নিয়ে শাহাবুদ্দীন স্যার বলেন, ‘যখন শিক্ষকতা শুরু করি তখন শিক্ষকদের তেমন মূল্যায়ন ছিল না। শিক্ষকেরা বেতন পেতেন সামান্য কিছু টাকা। শিক্ষক না হলে হয়তো অন্য পেশা বেছে নিতাম। কিন্তু শিক্ষকতার যে সম্মান, তা পেতাম না। হয়তো টাকা থাকত কিন্তু মানুষের ভালোবাসা পেতাম কি না সন্দেহ। যখন কেউ কাছে এসে পরিচয় দেয়, পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে, বুকে টেনে নেয় তখন বুকটা ভরে যায়, চোখে পানি চলে আসে। ভালোবাসার প্রাপ্তিতো এটুকুই।