আলোকিত করার স্বপ্নদ্রষ্টা
সত্যজিৎ ঘোষ, শরীয়তপুর ও ওমর ফারুক বৈশাখ
পূর্বে রাক্ষুসী মেঘনা, পূর্ব-দক্ষিণে দেশের সবচেয়ে বিপজ্জনক মেঘনা-ডাকাতিয়ার মোহনা, পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিমে আগ্রাসী পদ্মা, অর্থাৎ নদী দিয়ে বৃত্তাকারভাবে চারপাশ ঘিরে থাকা বিশাল বালুকাময় অঞ্চলের গ্রাম তারাবুনিয়া সখীপুর। নানান মৌলিক সুবিধাবঞ্চিত অগণিত মানুষের বসবাস এই বিশাল চরে। তাই বলা যায় নদীগুলোর ভাঙাগড়ার সঙ্গে বেশ সখ্য এই জীবনসংগ্রামী মানুষগুলোর। এমন বিচ্ছিন্ন, বঞ্চিত এই জনপদের শিক্ষা বা লেখাপড়াবিমুখ মানুষের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে চরটিকে আলোকিত করার স্বপ্নদ্রষ্টা একজন গুণী মানুষ এবং সেই স্বপ্নের বাস্তবায়নের বাস্তব রূপকার তথা এই চরাঞ্চলের সবার প্রিয় মানুষ বা প্রিয় মুখ সর্বজনশ্রদ্ধেয় শিক্ষক জনাব আবদুস সাত্তার (সাত্তার মাষ্টার)।
শরীয়তপুরের সখীপুর থানার (ভেদরগঞ্জ উপজেলা) ১২৯ নম্বর দক্ষিণ সখীপুর সিকদারবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুস সাত্তার। ওই এলাকার ব্যাপারীকান্দি গ্রামের ফয়সাল আহম্মেদ ও আনারকলি দম্পতির ছেলে তিনি। ১৯৭১ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তিন সন্তানের জনক। আবদুস সাত্তার ৫১ নম্বর সখীপুর জে এম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ১৯৮২ সালে। পঞ্চম শ্রেণিতে সাধারণ বৃত্তি পান। ১৯৮৩ সালে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন চরকুমারিয়া উচ্চবিদ্যালয়ে।
এই বিদ্যালয় থেকে ১৯৮৮ সালে এসএসসি পাস করেন। ঢাকার সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ থেকে ১৯৯০ সালে এইচএসসি এবং ১৯৯২ সালে বিএ পাস করেন।
বিএ পাস করার পর ঢাকায় পোশাক কারখানায় কাজ করেন। ভালো না লাগার কারণে বাড়িতে ফিরে বাবার কৃষিকাজে সহযোগিতা করতে শুরু করেন। শিক্ষকতা ছিল তাঁর স্বপ্ন। তাই ১৯৯৬ সালে ৫০০ টাকা বেতনে বেসরকারি একটি প্রাথমিক যোগ দেন। এই চরের বাসিন্দা না হয়েও এই চরের সুবিধাবঞ্চিত মানুষকে ঘিরে তিনি একজন মানবিক স্বপ্নদ্রষ্টা। সেই স্বপ্ন বা আকাঙ্ক্ষা থেকেই তিনি তরুণ বয়স থেকেই দীর্ঘ ২২-২৩ বছর ধরে। চরের মানুষের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার শপথে নিবেদিতপ্রাণ, চরের কিছু সচেতন আদর্শবান মানুষের সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠা করেন একটি অপরিহার্য স্কুল। সময় পরিক্রমা না প্রতিকূলতা, চড়াই-উতরাই পেরিয়ে খড়কুটো আর বাঁশ-টিনের আবরণের সেই ভুলটি আজ কংক্রিটের দ্বিতল ভবনের একটি স্কুল হয়ে চরের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের মাঝে শিক্ষা আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে। এবং প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত তিনিই নিজ যোগ্যতায় সম্মানের সঙ্গে শিক্ষক হিসেবেই বহাল আছেন। ২০১৩ সালে স্কুলটি জাতীয়বাগের আগে জাতীয়করণের দাবি দেশ ও আন্দোলনেও প্রিয় এই মানুষটির ভূমিকা ছিল অগ্রণী ও সর্বজন প্রশংসিত। দীর্ঘ ২২-২৩ বছর ধরে শুধু একজন প্রধান শিক্ষক হিসেবেই নয়, একজন আদর্শবান সং সাদাসিধে মানুষ হিসেবেও তিনি এই চরের মানুষের খুব প্রিয় একজন মানুষ। তাঁর স্কুলের নাম ১৯৯৯ দক্ষিণ মহীপুর সিকদারবাড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয় ।। অনেক কাঠগড় ও চড়াই-উতরাই পেরিয়ে নিজেরা জীবন একটি স্কুল তথা এই চরের মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া মানুষটি আজ মাকব্যাসে উপনীত হয়েও এখনো চরের মানুষের মধ্যে বিলিয়ে যাচ্ছেন প্রাতিষ্ঠানিক ও মানবিক শিক্ষার আলোকবর্তিকা, নিজে এই চরের বাসিন্দা নন, নিজ বাড়ি থেকে প্রতিদিন ১৪-১৫ মাইল কাঁচা-আধা পাকা রাস্তা, কনোকটি খাল-বিল, একটি নদীর দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে আসতে হয় চরের এই স্কুলে। এমনও হয়েছে খেয়াঘাটে নৌকা বা মাঝি না থাকলে তাকে কোমরপানি পেরিয়ে আসতে হতো। তাতেও তাঁর তৃপ্তি সীমাহীন। প্রতিদিন ফজরের নামাজ আদায় করেই তিনি হাঁটা শুরু করেন স্কুলের পথে। নানাভাবে তিনি চেষ্টা করেন সমাজ বা মানুষের জন্য কিছু করে যেতে, করোনাকালে স্কুল বন্ধের সময়ে কেউ যেন স্কুলবিমুখ না হয় বা শিক্ষাবিমুখ হয়ে না পড়ে বা লেখাপড়া যেন ভালোভাবে চালিয়ে যেতে পারে এ জন্য শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে নানা সাজেশন ও হোমওয়ার্ক দিয়ে তদারকি করতেন। ছাত্রছাত্রীদের নিজের সন্তানতুল্য মনে করে পরম স্নেহ-আদরযত্নে তিনি আগলে রাখেন। তাঁর মননে ও কর্মকাণ্ডে। করোনার সময়ে চরাঞ্চলজুড়ে বাল্যবিবাহের যে হিড়িক পড়ে গিয়েছিল, তা বন্ধেও তিনি ছিলেন বেশ সচেষ্ট, করোনায় ভুল বন্ধের সময় ছাত্রীদের বাড়ি বাড়ি তিনি বেশি যেতেন মূলত বাল্যবিবাহের আশঙ্কা ও প্রতিরোধচিন্তা মাথায় রেখেই।
সবার অতি প্রিয় এই মানুষটির মানবদরদি অনেক কর্মকাও অন্য সবার মনে দাগ কাটে সহজেই, মাদ্যশস্যজাতীয় ফসল উৎপাদনে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর কীটনাশক ব্যবহার পরিহার করার জন্য তিনি সব সময় উৎসাহ দেন এবং অনুরোধ করেন কৃষকদের। অর্থাৎ বিষমুক্ত সবজি উৎপাদনে তাঁর আরজি এই কৃষিপ্রধান অঞ্চলে বেশ সাড়া জাগিয়েছে। তাঁর এই মানবিক আবেদনে সায় দিয়ে অনেকেই এখন বিষমুক্ত সবজি উৎপাদন করছেন। তাই তিনি যখন বিশাল ফসলি জমির মধ্য দিয়ে কয়েক ঘণ্টার পথ হেঁটে স্কুলে যাওয়া-আসা করেন তখন খেতে কাজ করা অনেকেই তাঁকে সালাম দিয়ে কুশল জানতে চান। বেশ দূর থেকেও মানুষটিকে একনজর দেখাটাও যেন সবার কাছে বিশাল তৃপ্তির বিষয়। সব শ্রেণির মানুষের কাছেই এমন একজন ভালোবাসার মানুষ জনাব ‘সাত্তার মাষ্টার’। ঢাকার একটি শীর্ষস্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বেশ ভালো ফলাফলে বিএ পাস করার মানুষটিকে কোনো চাকরির প্রলোভন কাছে টানতে পারেনি। মাত্র ৫০০ টাকা বেতনেই তিনি শুরু করেছিলেন তাঁর শিক্ষকতাজীবন। যদিও মা-বাবা, স্ত্রী-সন্তান, ভাইবোনের বিশাল পরিবারের অনীহা অনুযোগ ছিল। কিন্তু তিনি তাঁর মানবিকতার পতাকাটাকে তুলে ধরার চেষ্টা করে গেছেন সব সময়ই। এই মানুষটির এমন মানবিক প্রচেষ্টা বা আহ্বানেই কৃষিপ্রধান এই চরের মানুষজন অনুধাবন করতে পেরেছেন, বিষমুক্ত মানবিক কৃষিপন্থা সুস্থ-সবল মানব অস্তিত্বের জন্য খুবই প্রয়োজন। তাঁর এমন মানবিক আহ্বানে সাড়া দিয়ে চরজুড়েই এখন বিষমুক্ত ফসল ফলানোর উৎসব চলছে যেন।
সমাজে তাঁর যথাযথ সম্মান ও গ্রহণযোগ্যতায় তিনি এই প্রতিরোধের কাজটিও করতে পেরেছেন বেশ সফলভাবেই।