অসহায়দের অনুপ্রেরণা
কামরান পারভেজ, ময়মনসিংহ
তাঁর পেশা শিক্ষকতা। বিদ্যালয়ের চারুকলার শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদের ছবি আঁকা শেখানোর কাজটি সঠিকভাবে কালেই দায়িত্ব শেষ। কিন্তু তিনি নিজেকেই এ রুটিন দায়িত্বের মধ্যেই বন্দী করতে চাননি। তিনি নিজের শিক্ষার্থীদের নিয়ে পাড়ালেন দরিদ্র ও অসহায় শিক্ষার্থীদের পরিবারের পাশে। গড়ে তুললেন একটি সংগঠন। তাঁর সঙ্গে যুক্ত হলেন আরও শিক্ষক। এখন স্বপ্ন দেখেন সারা দেশেই যেন ছড়িয়ে যায় এ চেতনা।
যার কথা বলা হচ্ছে তাঁর নাম তাপস মজুমদার। ময়মনসিংহের গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুলের জোষ্ঠ শিক্ষক। নিজের বিদ্যালয়ের বর্তমান ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের মধ্যে যাঁদের পরিবার দরিদ্র ও অসহায় তাঁদের পাশে অর্থসহায়তা দিতে তিনি গড়ে তুলেছেন ‘কাঠপেন্সিল’ নামের একটি সংগঠন। নিজের বিদ্যালয়ের সচ্ছল পরিবারের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে চাঁদা নিয়ে যাত্রা শুরু করে এ সংগঠন। কিছুদিনের মধ্যে কাঠপেন্সিলের কর্মকাণ্ডে আপ্লুত হয়ে বর্তমানে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকসহ আরও অনেক শিক্ষক, অন্য বিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক ও সাবেক শিক্ষার্থীরা কাঠপেন্সিলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন।
কাঠপেন্সিলের উদ্যোক্তা তাপস মজুমদার জানান এ সংগঠনের শুরুর কথা। শুরুটা ছিল ২০১৮ সালে। সেবার কয়েকজন শিক্ষার্থীকে নিয়ে তিনি শুরু করেন এ যাত্রা। শিক্ষার্থীদের বোঝানো হয় দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়ানোই প্রকৃত মানুষের কাজ। শিক্ষার্থীরা স্যারের এ কথায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দৈনিক টিফিনের টাকা থেকে কিছু টাকা জমা করে একটি তাহবিল গঠন করে। শিক্ষার্থীদের উৎসাহকে আরও বাড়িয়ে দিতে প্রতিদিন শিক্ষার্থীদের জমানো টাকার সঙ্গে আরও দ্বিগুণ টাকা যোগ করেন নিজের পকেটের টাকা থেকে। এভাবে তহবিল কিছুটা বড় হয়। পরিকল্পনা হয় ঈদে ছিন্নমূল শিশুদের জন্য নতুন জামা কিনে দেওয়া হবে। নিজেদের সামর্থ্য। আর একুশের চেতনার সঙ্গে মিলিয়ে সিদ্ধান্ত হয় ২১ জন শিশুকে নতুন জামা কিনে দেওয়া হবে। এ খবর কিছুটা জানাজানি হতে থাকলে তহবিলে আরও টাকা যোগ হতে থাকে নতুন নতুন শিক্ষার্থীদের সমা ২১ জনের আনসার ৫২ জনের জন্য নতুন ঝামা কেনার সিদ্ধান্ত হয়। এর মধ্যে আরও টাকা যোগ হয়ে যায়। পরে সিদ্ধান্ত বদল করে ৭১ জন শিশুকে ঈদের নতুন জামা কিনে দেওয়া হয়। এর মধ্যে সৃষ্টি হয় করোনার দুর্যোগ। দেখতে দেখতে নিজেদের বিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থীর অভিভাবক চাকরি হারিয়ে বা ব্যবসায় লোকসানের মুখে পড়ে অভাবগ্রস্ত হয়ে পড়েন। ওই অবস্থায় কাঠপেন্সিল ওই পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়িয়ে ব্যবসা করার জন্য টাকা দেয়। টাকা দেওয়ার শর্ত থাকে যে প্রতিদিন ন্যূনতম ১০ টাকা করে হলেও ফেরত দিতে হবে। ফেরত দেওয়া টাকা যুক্ত হবে কাঠপেন্সিলের তহবিলে।
কাঠপেন্সিলের সেবামূলক কাজে দারুণভাবে উৎসাহিত হয়ে এ সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন ময়মনসিংহের গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই-স্কুলের প্রধান শিক্ষক আঞ্জুমানারা কবিতা। তিনি যুক্ত হওয়ার পর কাঠপেন্সিলের পরিধি আরও বাড়ছে। যুক্ত হয়েছেন নিজের স্কুলের আরও অনেক শিক্ষক, প্রাক্তন শিক্ষার্থীসহ ময়মনসিংহের অন্যান্য স্কুলের শিক্ষকেরা।
কাঠপেন্সিল নাম প্রসঙ্গে এর উদ্যোক্তা বলেন, একজন মানুষের জীবনের শুরু থেকে কাঠপেন্সিল কাজে আসে। কাঠপেন্সিল নিজে ক্ষয় হয়ে অন্যকে বড় করে। আমার চাওয়া শিক্ষার্থীরাও যেন এ চেতনায় বেড়ে ওঠে। মানুষের সেবাকে যেন বড় কাজ বলে জানতে শেখে। এ চিন্তা থেকেই সংগঠনের নাম কাঠপেন্সিল করা হয়েছে।
অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো খুব কঠিন কিছু না। যদি আমাদের ইচ্ছা থাকে তাহলেই সম্ভব। আমাদের স্কুলের শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ২ হাজার। এর মধ্যে খুব বেশি হলে ২০টি পরিবার দরিদ্র বা অসহায়। আমার মনে হয় ময়মনসিংহের বাকি স্কুলগুলোসহ সারা দেশের অবস্থাও একই রকম। কাজেই সবাই মিলে অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানো খুব কঠিন না। তাপস মজুমদার ৩০ বছর ধরে শিক্ষকতা করছেন। এই ৩০ বছর ধরেই তিনি শিক্ষার্থীদের আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। অনিয়ম, দুর্নীতি আর অসৎভাবে টাকা উপার্জনের চেয়ে সৎ পথে থেকে কম উপার্জন করে চলা শ্রেয়, এ দীক্ষা তিনি ছড়িয়ে যাচ্ছেন নিজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে।