অদম্য অসহায় শিক্ষার্থীদের ভরসা
আরিফুল হক রুজু, রংপুর
অবসরপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষক শফিয়ার রহমানের জন্ম ৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৬২। স্ত্রী ও দুই সন্তান রয়েছে তাঁর। তিনি বর্তমানে রংপুর শহরের কেরানীপাড়ায় বসবাস করেন। তাঁর গ্রামের বাড়ি লালমনিরহাট জেলার হাতিবান্ধা উপজেলার উত্তর ডাউয়াবাড়ি গ্রাম। গ্রামেই তাঁর জন্ম। তাঁর এক ছেলে কম্পিউটার সায়েন্সে অনার্স করে চাকরি করছেন। মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর পরীক্ষার্থী। স্ত্রী সেতারা আক্তার পারভীন গৃহিণী। তাঁর বাবা মরহুম আখ্যার রহমান। পেশায় ছিলেন একজন কৃষক। মা সাবেরা বেগম। ছিলেন গৃহিণী। শফিয়ার রহমান আট ভাইবোনের মধ্যে পঞ্চম।
স্কুলজীবন কেটেছে হাতিবান্ধা উপজেলার দক্ষিণ পারুলিয়ার পারুলিয়া তফসিলি দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয়ে। এরপর রংপুর সরকারি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে ভর্তি হন রংপুরের সরকারি কারমাইকেল কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগে। স্নাতক পাস করে স্নাতকোত্তর করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এরপর রংপুর আইন কলেজ থেকে এলএলবি ডিগ্রি নেন। একই সঙ্গে রংপুর টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে বিএড ডিগ্রি লাভ করেন। চাকরিজীবনের শুরু হয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতা দিয়ে। সেখানে দুই বছর চাকরি করার পর সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন।
এই চাকরির শুরুতে তিনি চুয়াডাঙ্গা সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে তাঁর চাকরির জীবন শুরু হয়। সেখানে তিনি প্রায় ছয় বছর চাকরি করার পর গাইবান্ধা সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে বদলি হয়ে আসেন। এখানে তিন বছর চাকরি করার পর তিনি রংপুর জিলা স্কুলে যোগদান করেন। এই স্কুলে প্রায় ১৮ বছর সুনামের সঙ্গে শিক্ষকতা করেছেন। শিক্ষার্থীর সঙ্গে ছিল বন্ধুসুলভ সম্পর্ক। শিক্ষার্থীর কোনো অসুবিধা হলে অভিভাবকেরা প্রথম তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতেন।
তিনি জিলা স্কুলে থাকা অবস্থায় গণিত উৎসব, ভাষা প্রতিযোগ, বিজ্ঞান উৎসবসহ বিভিন্ন ভালো কর্মকাণ্ডে তাঁর চেষ্টা ছিল মনে রাখার মতো। শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ও উৎসব যাতে সুন্দরভাবে হয় এ জন্য তিনি সার্বক্ষণিক কাজ করেছেন। বিজয়ী শিক্ষার্থীদের নিয়ে রংপুরের বাইরেও গিয়েছেন। স্কুলে বিতর্কচর্চা, দেয়ালপত্রিকা উৎসব, পয়লা বৈশাখে নিজেই লাঠিখেলা দেখিয়ে সব ধরনের খেলাখুলায় অংশগ্রহণ ছিল তাঁর। ছোটবেলায় তিস্তা নদীর পাড়ে থেকে নদীভাঙন ও বন্যাকবলিত মানুষের দুঃখ খুব কাছ থেকে দেখেছেন তিনি। পরবর্তী সময়ে তিনি তাঁর চাকরিজীবনে ভাবলেন, স্কুলে অদম্য অসহায় শিক্ষার্থীদের পাশে থাকতে হবে। তাদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। আর্থিক দীনতায় এমন অদম্য শিক্ষার্থীরা যেন ঝরে না পড়ে, পিছিয়ে না যায়। তাই এসব শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন সময় তিনি তাঁর নিজ বাড়িতে পড়াশোনা করাতেন। একই সঙ্গে এসব শিক্ষার্থীর বাড়িতে গিয়েও খোঁজখবর নিতেন। এর পাশাপাশি তিনি অসহায় শিক্ষার্থী পরিবারেরও আপদে-বিপদেও পাশে দাঁড়াতেন।
রংপুর জিলা স্কুলের বিশাল এলাকাজুড়ে ছিল ঝোপজঙ্গল। সেখানে তিনি নিজে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে নানা জাতের গাছ রোপণ করেন। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে খরা মৌসুমে তিনি পানি দেওয়াসহ গাছের পরিচর্যা করতেন। এসব গাছ এখন অনেক বড় হয়েছে। স্কুলটি সবুজায়ন হয়ে ওঠে। স্কুলে একজনমাত্র পরিচ্ছন্নতাকর্মী থাকায় দুই শিফটের ক্লাস পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা সম্ভব হয়ে উঠত না। এ সময় তিনি বসে থাকলেন না। তিনি নিজে ক্লাস-কক্ষ পরিষ্কার অভিযানে শিক্ষার্থীদের নিয়ে নেমে পড়েন। এটি নিয়মিত করতেন। এতে অভিভাবকদের কটুকথাও শুনতে হয়েছে। এরপরও তিনি থেমে যাননি।
বর্তমানে তিনি তিস্তা নদী সুরক্ষায় ‘তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। এই সংগঠনের মাধ্যমে তাঁর নেতৃত্বে ইতিমধ্যে নদীতীরবর্তী দুই পাড়ে ২৩০ কিলোমিটারব্যাপী মানববন্ধন কর্মসূচি হয়েছে। এতে নদীপারের হাজার হাজার মানুষ অংশ নেয়।