বারবারের ব্যর্থতা থেকে সফল সংগঠক

মুক্তার হোসেন, নাটোর

১৯৮০ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণের পর বাবা মেহের উদ্দিন অষ্টম সন্তানের নাম রেখেছিলেন হোসেন আলী। তবে স্কুলজীবনের শুরুতে গৃহিণী মা হাজেরা খাতুনের ইচ্ছায় তাঁর নাম বদলে রাখা হয় হায়দার আলী। বাবার তেমন একটা প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি ছিল না। তবে নিজের চেষ্টায় যেটুকু জ্ঞান অর্জন করেছিলেন, তা শিশুদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য বিনা বেতনে দিয়াড় গাড়া ভান্ডারদহ বেসরকারি রেজিষ্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। বিদ্যালয়টি সরকারি হওয়ার সময় তিনি স্বেচ্ছায় শিক্ষকতা থেকে অবসর নেন।

নাটোর জেলার বড়াইগ্রাম উপজেলার দিয়াড় গাড়ফা গ্রামে জন্ম নেওয়া হায়দার আলী পাঁচ বোন ও চার ভাইয়ের মধ্যে অষ্টম। পারিবারিক অসচ্ছলতার কারণে অন্য ভাইবোনেরা পড়ালেখা করতে পারেননি। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত তিনি নিজেও পড়ালেখায় তেমন একটা মনোযোগী ছিলেন না। তবে বারবারের ব্যর্থতা তাঁকে হতাশ করতে পারেনি। তিনি পড়ালেখায় ভালো করার সংকল্প করেন। সাধারণ শিক্ষা ছেড়ে মাদ্রাসায় ভর্তি হন। ১৯৯৪ সালে প্রথম বিভাগে দাখিল পাস করেন। ১৯৯৬ সালে বনপাড়া ডিগ্রি কলেজ থেকে বিজ্ঞান শাখা থেকে দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ২০০০ সালে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে গণিতশাস্ত্রে স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রি অর্জন করেন। একই বছর গ্রামের ডিকে উচ্চবিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। শিক্ষকতার শুরুতেই তিনি স্কুলের অপেক্ষাকৃত দুর্বল শিক্ষার্থীদের মান উন্নয়নে তৎপর হন। গঠন করেন ‘ডিকে ছাত্র ইউনিট’ নামের একটি শিক্ষামূলক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। গ্রামের যেসব শিক্ষার্থী বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করছেন তাদের এই সংগঠনে যুক্ত করেন। সংগঠনের সদস্যরা নিজেরা ও শিক্ষানুরাগীদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে ডিকে উচ্চবিদ্যালয়ে অস্থায়ী ছাত্রাবাস প্রতিষ্ঠা করেন। এবং কৃতী শিক্ষার্থীদের সম্মাননা জানান। যেসব শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষার জন্য মনোনীত হতো। তাদের পরীক্ষা পর্যন্ত এই ছাত্রাবাসে রেখে পড়ালেখা করানো হতো। শিক্ষক হায়দার আলী নিজে ছাত্রাবাসে থেকে তাদের তত্ত্বাবধান করতেন। নিজের ব্যাংক হিসাব থেকে ঋণ তুলে তা দরিদ্র শিক্ষার্থীদের ধার নিতেন। সুবিধামতো সময়ে তারা সে ঋণ পরিশোধ করত। হায়দার আলী পারিবারিক জীবনে বিবাহিত। সংসারে স্ত্রী নার্গিস খাতুন ছাড়াও দুই ছেলে নাফিজ হায়দার (নবম শ্রেণিতে পড়ে) ও মাহফুজ হায়দার (সপ্তম শ্রেণি) রয়েছে। পারিবারিকভাবে পাওয়া তিন বিঘা আবাদি জমি ও শিক্ষকতা থেকে অর্জিত আয় দিয়ে তাঁর সংসার চলে। ছোটবেলায় হায়দার আলীর মাছ ধরার শখ ছিল। পড়ালেখা ফাঁকি দিয়ে তিনি উন্মুক্ত জলাশয়ে মাছ ধরেও অনেক সময় ব্যয় করতেন। তবে শিক্ষকতা শুরুর পর কম্পিউটার শেখা ও শেখানো প্রতি আগ্রহ বেড়ে যায়। ২০০৬ সালে তিনি জনতা ব্যাংক থেকে ২৩ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে কম্পিউটার কেনেন। কম্পিউটার চালানো শেখার পর তিনি গ্রামের বাজারে একটি প্রশিক্ষণকেন্দ্র গড়ে তোলেন। সেখানে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দেওয়ার পাশাপাশি ছবি, প্রিন্ট, ই-মেইল পাঠানোসহ নানা ব্যবস্থা রাখেন। এখান থেকে কম্পিউটার শিখে তাঁর একজন ছাত্র পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার বিষয়ে পড়ালেখা করে। তাঁর মধ্যস্থতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের একজনের শিক্ষকের সহযোগিতায় তিনি ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন তৈরির কাজ শেখেন। ইতিমধ্যে তিনি। ২০টি বিদ্যালয়ের ওয়েবপেজ তৈরি করে দিয়েছেন। এ ছাড়া তিনি অবসরে প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেন। তাঁরা গ্রামে তাঁদের সময় দেন। তাঁদের নিয়ে সামাজিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন। তিনি জানান, সব শিক্ষার্থীই তাঁর কাছে প্রিয়। তবে তাঁদের মধ্যে সোনালী ব্যাংকের কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার রাকিবুল ইসলাম, ডিপিডিসির সহকারী প্রকৌশলী রকিবুল ইসলাম, বাংলাদেশ ব্যাংকে কর্মরত মিরাজুল ইসলাম ও লেদার ইঞ্জিনিয়ার সুলতান মাহমুদ অন্যতম।

Categories সম্মাননা ২০২১