শিক্ষক শুধু পাঠদাতা নন—তিনি স্বপ্নের কারিগর। তাঁর হাতে গড়ে ওঠে মূল্যবোধ, নৈতিকতা আর জীবনের সঠিক পথচলার মানচিত্র। তবু শিক্ষাকে জাতির মেরুদণ্ড বলা হলেও শিক্ষক আজ অবহেলার ছায়ায় ঢাকা। দীর্ঘদিন ধরে অবমূল্যায়ন ও অনাদরের শিকার এই মানুষগুলো। এমন বাস্তবতায় শিক্ষকদের সম্মাননা জানানোর এ উদ্যোগ যেন মরুভূমিতে এক ফোঁটা বৃষ্টির মতো। এটি জাগাবে শিক্ষার প্রতি নতুন প্রজন্মের আগ্রহ, আর কিছুটা হলেও ফিরিয়ে দেবে শিক্ষকের প্রাপ্য মর্যাদার দীপ্তি।
খুলনায় ‘আইপিডিসি-প্রথম আলো প্রিয় শিক্ষক সম্মাননা ২০২৫’ উপলক্ষে আয়োজিত সুধী সমাবেশে উপস্থিত বিশিষ্টজনেরা এসব কথা বলেন। আজ সোমবার বিকেল সাড়ে পাঁচটায় নগরের মুজগুন্নী আবাসিক এলাকা, আউটার বাইপাস সড়কের উল্লাস পার্কের দ্য আর্টইয়ার্ড ক্যাফেতে এই সমাবেশের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, কবি, লেখক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিক্ষার্থীসহ নানা শ্রেণি–পেশার মানুষ অংশ নেন।
জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়। পরে সম্প্রতি রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। সুধী সমাবেশে বক্তব্যের ফাঁকে ফাঁকে ‘মজুমদার স্যার’ ও ‘আখতার স্যার’ শিরোনামে দুটি ভিডিও চিত্র দেখানো হয়। শিক্ষকদের প্রতি সম্মান জানানোর ভিডিও দেখে উপস্থিত সবাই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন।

আইপিডিসি-প্রথম আলো প্রিয় শিক্ষক সম্মাননা ২০২৫
সমাবেশে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলেন, ‘শিক্ষকতা নেশার সঙ্গে পেশার মিশেল। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে একজন শিক্ষক তাঁর ব্যাটনটা আরেকজনের কাছে তুলে দেন। সাধারণের দুটো চোখ, কিন্তু শিক্ষকের তিনটা চোখ। তিনি অন্তর্চক্ষু দিয়ে তাঁর ছাত্রের ভালো–মন্দ, দুর্বলতা-সবলতা দেখতে পান। আমাদের ছোটবেলায় অভিভাবকের চেয়ে শিক্ষকেরা আমাদের দিকে নজর দিতেন বেশি। এখন শিক্ষকদের চেয়ে অভিভাবক বেশি নজর দেন।’
প্রথম আলোর সম্পর্কে আনোয়ারুল কাদির বলেন, ‘সকালের প্রথম সূর্য যেমন ভিটামিন ডি দেয়, প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে তোলে। প্রথম আলো তেমনি প্রভাতের সে সূর্যের আলো, অরুণোদয়ের আলো। প্রথম আলো সেই প্রতিরোধশক্তি তারুণ্যের মধ্যে দিয়ে দিতে পারছে, এমনকি আমাদের মতো বৃদ্ধদের মধ্যে তারুণ্যের শক্তি জোগান দিচ্ছে প্রথম আলো।’
খান বাহাদুর আহসানউল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আনিসুর রহমান বলেন, শিক্ষক সম্মাননার আয়োজন পাঁচ বছর ধরে হচ্ছে, তবে বিষয়টা এখন বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। গত এক বছরের শিক্ষকদের নিয়ে আমরা নানা কাণ্ডকারখানা দেখেছি, শিক্ষকদের লাঞ্ছিত হতে, তাঁদের অপমানের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে যেতে দেখেছি।’
খুলনায় আইপিডিসি-প্রথম আলো প্রিয় শিক্ষক সম্মাননা অনুষ্ঠানে অতিথিরা। গতকাল বিকেলে খুলনা নগরের মুজগুন্নী উল্লাস পার্কের একটি ক্যাফেতেছবি: প্রথম আলো
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক তুহিন রায় বলেন, ‘বর্তমানে আমরা জটিল একটা সময় পার করছি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক বেশি সময় ব্যয় করার প্রবণতাটা ভয়ংকর হয়ে উঠছে। শিক্ষক ও অভিভাবক সবাইকে আমাদের সন্তানদের প্রতি বাড়তি নজর রাখার সময় এখন।’
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক কাজী মাসুদুল আলম বলেন, ‘শিক্ষাক্ষেত্র ও গবেষণাক্ষেত্রে আরও বিনিয়োগ বাড়ালে তবেই আমরা অ্যাডভ্যান্স বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকব। না হলে অগ্রসরমাণ পৃথিবী থেকে আমরা অনেক পিছিয়ে পড়ব।’
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় স্কুলের প্রধান শিক্ষক স্বর্ণকমল রায় বলেন, ‘শিক্ষক জ্ঞানদাতা শিক্ষার্থী জ্ঞানগ্রহীতা। অবাণিজ্যিক যুগে ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক ছিল একটা বন্ধন। আজকাল কোন শিক্ষকের কোচিংয়ে কত বেশি শিক্ষার্থী, তার ভিত্তিতে জনপ্রিয়তা যাচাই করা হয়। আজ আমরা শিক্ষকেরা বিক্রেতা, শিক্ষার্থী ক্রেতা। আর শুধু এ কারণেই শিক্ষকের সামাজিক মর্যাদা–সম্মান আগের মতো পাই না।’
অনুষ্ঠানের শুরুতে স্বাগত বক্তব্য দেন প্রথম আলোর খুলনা প্রতিনিধি উত্তম মণ্ডল। খুলনা বন্ধুসভার সহসভাপতি এম এম মাসুম বিল্যাহর সঞ্চালনায় শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন আইপিডিসি খুলনার শাখা ব্যবস্থাপক মো. রাশেদুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, আইপিডিসি বিশ্বাস করে, শিক্ষকের ত্যাগই একটি জাতিকে গড়ে তোলে। শিক্ষকদের কথা ভেবে তাঁদের সম্মান জানাতে আইপিডিসি ‘প্রজ্ঞা’ নামে একটি বিশেষ ঋণ প্রকল্প চালু করেছে। সহজ শর্ত, দ্রুত সেবা ও ন্যূনতম সুদে শিক্ষক ও অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকেরা ঋণ গ্রহণ করতে পারবেন। যে জাতি শিক্ষকের সম্মান করে, সে জাতি কখনো অন্ধকারে হারিয়ে যায় না।
সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন ন্যাশনাল ডিবেট ফেডারেশন বাংলাদেশের খুলনা অঞ্চলের মডারেটর তাকদীরুল গনী, সাহিত্য সংসদের সভাপতি সাইফুল ইসলাম মল্লিক, সরকারি আযম খান কমার্স কলেজের সহযোগী অধ্যাপক তারক চাঁদ ঢালী, খুলনা পিটিআইয়ের ইনস্ট্রাক্টর (কম্পিউটার সায়েন্স) এস এম রবিউল হক প্রমুখ।
আয়োজকেরা জানান, শিক্ষকদের সম্মান জানাতে আইপিডিসি ফাইন্যান্স পিএলসি ও প্রথম আলোর যৌথ উদ্যোগে পঞ্চমবারের মতো ‘আইপিডিসি-প্রথম আলো প্রিয় শিক্ষক সম্মাননা ২০২৫’ শুরু হয়েছে। এবার পঞ্চমবারের মতো এই সম্মাননা দেওয়া হবে আগামী অক্টোবরে। আগ্রহী ব্যক্তিরা অনলাইনে (www. priyoshikkhok. com) এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে মনোনয়ন করতে পারবেন। চলতি বছর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক, দুই ক্যাটাগরি থেকে মোট সাতজন শিক্ষককে ‘প্রিয় শিক্ষক সম্মাননা ২০২৫’ দেওয়া হবে। এ সম্মাননার জন্য মনোনয়নযোগ্য শিক্ষক হতে হলে তাঁর বয়স কমপক্ষে ৪০ বছর হতে হবে। কর্মরত বা অবসরপ্রাপ্ত—উভয় অবস্থাতেই মনোনয়নযোগ্য। মনোনয়নদাতা ও শিক্ষক উভয়কেই বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে এবং এক ব্যক্তি সর্বোচ্চ তিনজন শিক্ষককে মনোনয়ন দিতে পারবেন।