শৃঙ্খলা আর সততায় গড়েন আগামী প্রজন্ম

শেখ মনিরুজ্জামান
প্রধান শিক্ষক
মোবাইদুল ইসলাম মাধ্যমিক বিদ্যালয়, বাগেরহাট

বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার সম্মানকাঠী গ্রামের এক সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসা শেখ মনিরুজ্জামান আজ এক প্রেরণার নাম। মোবাইদুল ইসলাম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শেখ মনিরুজ্জামান। তিনি শিক্ষার্থীদের জীবনবোধ, শৃঙ্খলা আর সততা শিখিয়ে গড়ে তুলছেন আগামী দিনের সৎ ও দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে।

শেখ মনিরুজ্জামান মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, ‘সততা, নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলা ছাড়া কোনো শিক্ষাই পূর্ণতা পেতে পারে না।’ তাই তিনি শিক্ষার্থীদের বিষয়ে কখনোই শিথিল নন। কেউ স্কুলে দেরিতে এলে কিংবা নিয়ম ভঙ্গ করলে তিনি তুচ্ছ মনে করেন না। তিনি বলেন, ‘আজ যে শিক্ষার্থী দেরিতে স্কুলে আসে, কর্মজীবনেও সে প্রতিষ্ঠানে দেরিতে যাবে।’ তিনি চালু করেছেন প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্য আলাদা প্রোফাইল। সেখানে শুধু ফলাফল নয়, শিক্ষার্থীর আচরণ, সহশিক্ষামূলক কার্যক্রম থেকে অপরাধও লেখা থাকে। ফলে প্রতিটি শিক্ষার্থী বুঝতে শেখে—শিক্ষা শুধু বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ নয়, এটা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে দায়িত্বশীলতা ও সততার সঙ্গে যুক্ত।

প্রধান শিক্ষক হওয়ার পর থেকে অভিনব নানা উদ্যোগ নিয়েছেন মনিরুজ্জামান। প্রতিটি ক্লাসে চালু করেছেন ‘খুদে ডাক্তার কার্যক্রম’। এই কার্যক্রমে কিছু শিক্ষার্থীকে প্রাথমিক চিকিৎসার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। কেউ অসুস্থ হলে এগিয়ে আসে তারাই। জরুরি প্রয়োজনে হাসপাতালে নেওয়া বা বাসায় পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থাও করে এই খুদে ডাক্তাররা। তাঁর সঙ্গে কথা বলার সময়ই দেখা গেল, অষ্টম শ্রেণির দুই শিক্ষার্থী এসে জানাচ্ছে যে তারা এক সহপাঠীকে হাসপাতাল থেকে বাসায় পৌঁছে দিয়েছে।

শেখ মনিরুজ্জামান ‘ইউজার্স’ নামে একটি গ্রুপ তৈরি করেছেন। এই গ্রুপ ক্লাসরুম, মাঠ, টয়লেট—সব জায়গার পরিচ্ছন্নতা তদারক করে। মেয়েশিক্ষার্থীদের জন্য নিশ্চিত করেছেন স্যানিটারি ন্যাপকিন ও হাইজিন সুবিধা।
এ ছাড়া নিয়মিত বিজ্ঞান ক্লাব, কিশোর-কিশোরী ক্লাব, সততা সংঘ, স্কাউটিং ও গার্ল গাইডস কার্যক্রম চালু রয়েছে। নিয়মিত হয় অভিভাবক ও শিক্ষকের মিটিং। ১৯৭০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর জন্ম শেখ মনিরুজ্জামানের। বাবা স্বাস্থ্য পরিদর্শক ছিলেন, তাই গ্রামে দাদা-চাচাদের সঙ্গে বড় হয়েছেন। চার ভাই–বোনের মধ্যে সবার বড় মনিরুজ্জামান। স্ত্রী ফেরদৌসী আক্তার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক।

১৯৯২ সালে স্থানীয় এস এম মাহবুবর রহমানের হাত ধরে তিনি ‘আদর্শ শিশু একাডেমি’ নামের একটি কিন্ডারগার্টেন শুরু করেন। বছর না ঘুরতেই স্কুলের দায়িত্ব আসে তাঁর কাঁধে। ২০০২ সালে প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে শুরু করেন নতুন পথচলা, যেটি আজকের মোবাইদুল ইসলাম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে।

শুরুতে ‘আদর্শ নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়’ হিসেবে যাত্রা করা প্রতিষ্ঠানটি ২০০৭ সালে প্রথমবার এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়। ধীরে ধীরে এটি জেলার অন্যতম সেরা বিদ্যালয়ে পরিণত হয়। শিক্ষকদের মানোন্নয়নের জন্য তিনি চালু করেছেন নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও ক্লাস পর্যবেক্ষণ। একজন শিক্ষকের ক্লাস থেকে অন্য শিক্ষকেরাও যাতে শিখতে পারেন—এমন পরিবেশ তৈরি করেছেন। খেলাধুলা, সংগীত, বিতর্কের মতো কার্যক্রমের জন্য নিয়মিত শিক্ষকের পাশাপাশি নিয়োগ করেছেন খণ্ডকালীন শিক্ষক—এগুলো শিক্ষার্থীদের বহুমুখী বিকাশ ঘটাতে সহায়ক। বিদ্যালয়ে হাতে-কলমে শিক্ষার পরিবেশও তৈরি করেছেন তিনি। শেখ মনিরুজ্জামান শুধু দিনে নয়, রাতেও শিক্ষার্থীদের খোঁজ রাখেন। রাত ৯টা থেকে ১১টা পর্যন্ত তিনি নিয়মিত শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ান। সব তথ্য নিজের নোটে সংরক্ষণ করেন তিনি।

শেখ মনিরুজ্জামান বলেন, ‘পড়াশোনা সার্টিফিকেট তৈরির জন্য নয়, এখানে প্রতিটি শিক্ষার্থীকে ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা আমাদের দায়িত্ব।’ কোনো ছুটির দিন নেই তাঁর। প্রয়োজনে শুক্র-শনিবারও বিদ্যালয়ে আসেন। তাঁর চোখে একটাই স্বপ্ন—‘শিক্ষার্থীরা শুধু পরীক্ষায় ভালো করবে না, তারা হবে আলোকিত মানুষ।’

ইনজামামুল হক, বাগেরহাট

Scroll to Top