আজমীরা খানম
সিনিয়র শিক্ষক
বীণাপাণি সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ
শিক্ষক শব্দটি উচ্চারণ করলে যে চিত্রটি চোখে ভেসে ওঠে, তা হলো জ্ঞান বিতরণকারী বা পথপ্রদর্শক। কিন্তু কিছু শিক্ষক আছেন, যাঁরা শুধু পাঠ্যবই নয়, জীবনে আসেন আলোকবর্তিকা হয়ে। গোপালগঞ্জের শিক্ষিকা আজমীরা খানম ছিলেন তেমনই একজন। শিক্ষার্থীদের কাছে তিনি শুধু শিক্ষক নয়, পরিবারের এক আপনজন। তিনি বিশ্বাস করেন, শিক্ষা শুধু বইয়ের অক্ষর নয়, এটি জীবনের চালিকা শক্তি, যা মানুষকে মানুষ করে গড়ে তোলে।
বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছে আজমীরা খানম একটি ভালোবাসার নাম। ব্যবহার, মেধা, ধৈর্য, নম্রতা ও পাঠদানের ব্যতিক্রমী কৌশলের কারণে শিক্ষার্থীরা তাঁকে আপন করে নিয়েছে।
ওই বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক রেশমা আক্তার হাসি, মৃন্ময় বাড়ৈ, বর্তমান শিক্ষক সদানন্দ বিশ্বাস, নাসির আহমেদসহ অন্তত ১০ জন শিক্ষক এবং সাবেক ও বর্তমান ১৫ জন শিক্ষার্থী জানান, আজমীরা খানম বীণাপাণি সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের এক অনন্য নাম। তিনি বিনয়ী ও মমতাময়ী শিক্ষিকা ছিলেন। প্রত্যেক শিক্ষার্থীর সঙ্গেই আলাদা সম্পর্ক রয়েছে তাঁর। শিক্ষার্থীদের মনের ভেতরে তিনি প্রবেশ করতে পেরেছেন তাঁর ব্যবহারের জন্য।
এ ছাড়া বিদ্যালয়ের অন্য শিক্ষকদের সঙ্গে আজমীরা খানমের রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। পাঠদানের ক্ষেত্রে তিনি নিজের সর্বোচ্চটা দিয়েই চেষ্টা করেন।
বীণাপাণি সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রী বর্তমানে বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষার্থী অর্পিতা কবির বলেন, ‘গোপালগঞ্জের শিক্ষাঙ্গনে গর্বের সঙ্গে উচ্চারিত এক নাম “ইংরেজি শিক্ষিকা আজমীরা ম্যাডাম”। তিনি শুধু পড়াতেন না, আমাদের জীবন গড়তেও বড় ভূমিকা রেখেছেন। যতবারই আমরা প্রশ্ন করতাম, ম্যাডাম ধৈর্য ধরে প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দিতেন। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল অনন্য। তিনি কেবল শিক্ষক হয়ে থাকেননি, ছিলেন বন্ধুর মতো। আমরা ব্যক্তিগত সমস্যাও তাঁর কাছে খুলে বলতে পারতাম। তিনি মন দিয়ে শুনতেন এবং প্রয়োজনমতো সঠিক পরামর্শ দিতেন। পড়ানোর ধরনে ছিল অভিনবত্ব। তিনি গল্প বলার ঢঙে পাঠ দিতেন, নতুন শব্দ শেখাতে ছোট ছোট খেলা খেলাতেন, নাটকের সংলাপ ব্যবহার করাতেন। এতে শিক্ষার্থীদের উচ্চারণ ঠিক হতো এবং আত্মবিশ্বাস বাড়ত। ফলে ইংরেজি, যা আগে ভয়ংকর মনে হতো, তাঁর ক্লাসে হয়ে উঠত আনন্দময়। আমার নিজের ইংরেজি দক্ষতা গঠনে তাঁর অবদান অপরিসীম। আগে ইংরেজি বলতে ভয় পেতাম, ক্লাসে হাত তুলতেও সংকোচ বোধ করতাম। কিন্তু ম্যাডাম সব সময় উৎসাহ দিতেন “ভুল হলেও বলো।” সেই উৎসাহেই ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছি। আমাদের কাছে তিনি শুধু সেরা শিক্ষক নন, সেরা মানুষও।’
সাবেকুন নাহার অহনা নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘কিছু মানুষ আছেন যাঁরা জীবনের ঠিক সময়টায় আমাদের সামনে এসে দাঁড়ান আলো হয়ে। জীবনের পাঠ্যবই যখন দুর্বোধ্য লাগে, তখন তাঁরা শব্দের বাইরেও অর্থ খুঁজে দেন। আমার জীবনে সেই আলোকবর্তিকা হলেন আজমীরা খানম। তিনি কেবল ইংরেজি শেখাননি, মানুষ হতে শিখিয়েছেন। ২০০৬ সাল থেকে ভিন্নধর্মী ও সৃজনশীল শিক্ষাদানের মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করেছেন, তিনি শুধু সেরা শিক্ষক নন, একজন আদর্শ মানুষও। তিনি চাইতেন আমরা শুধু ভালো শিক্ষার্থী নয়, ভালো মানুষও হই। পড়াশোনার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক ও দক্ষতা উন্নয়ন কার্যক্রমেও তিনি আমাদের উৎসাহিত করতেন।
‘আজমীরা ম্যামের মানবিকতার পরিসর শুধু আমাকে আবদ্ধ রাখেনি। যে শিক্ষার্থীই সমস্যায় পড়েছে, তিনি সহায়তার দরজা খুলে দিয়েছেন। মুগ্ধকর বিষয় হলো অগণিত ভালো লাগা ও ভালোবাসা সত্ত্বেও তিনি নিরহংকার। সবার অনুভূতির প্রতি তিনি সম্মান দেন। আজও চোখ বুজলেই শুনতে পাই তাঁর বোর্ডে চক ঘষার সেই পরিচিত শব্দ আর সেই কণ্ঠস্বর—যেন ভোরের প্রথম আলো ছুঁয়ে আসা এক নতুন দিনের আহ্বান। সেই সুর আর ঘ্রাণকে আজ ভীষণ মিস করি।
‘স্কুলজীবন পেরিয়ে বহু বছর হয়ে গেছে, তবু আজও দ্বিধা, দুশ্চিন্তা বা অভিমান যখনই জীবনের দরজায় কড়া নাড়ে, আমি ফোন দিই। তিনি আগের মতোই মনোযোগ দিয়ে শোনেন, প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেন এবং ভরসা জোগান।
‘আজমীরা খানম কেবল একজন শিক্ষক নন, তিনি আমার ভাঙাগড়ার সাক্ষী, পথহারা সন্ধ্যার দিকচিহ্ন।’
নুতন শেখ, গোপালগঞ্জ