শিক্ষার আলো ছড়ানোর আলোকবর্তিকা

রনজিৎ চন্দ্র দাশ
অধ্যক্ষ
গণউদ্যোগ বালিকা উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজ, কুমিল্লা

রনজিৎ চন্দ্র দাশ কুমিল্লার লাকসামের একজন আদর্শ শিক্ষক। তিনি প্রমাণ করে চলেছেন—একজন আদর্শ শিক্ষক শুধু শ্রেণিকক্ষেই সীমাবদ্ধ থাকেন না, তাঁর কর্মপরিধি সমাজজুড়ে বিস্তৃত।

বর্তমানে লাকসামের গণউদ্যোগ বালিকা উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ। তাঁর সুশৃঙ্খল শিক্ষাব্যবস্থার কারণে এ বছর এসএসসি পরীক্ষায় লাকসাম উপজেলায় প্রথম হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। একই ধারা দেখা গেছে সর্বশেষ প্রকাশ হওয়া এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলেও। রনজিৎ দাশ ১৯৭৪ সালের ৪ সেপ্টেম্বর কুমিল্লার লাকসামের চানগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা প্রয়াত রাখাল চন্দ্র দাশ আর মা প্রয়াত নেপালী রানী দাশের পাঁচ ছেলে-মেয়ের মধ্যে সবার ছোট তিনি। স্ত্রী বিউটি মজুমদার লাকসামের দৌলতগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক।

রনজিৎ চন্দ্র দাশ হরিশ্চর ইউনিয়ন উচ্চবিদ্যালয় থেকে ১৯৯০ সালে এসএসসি, ১৯৯২ সালে লাকসাম নওয়াব ফয়জুন্নেছা সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ১৯৯৪ সালে একই প্রতিষ্ঠান থেকে বিএসসিতে উত্তীর্ণ হন। পরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে এমএসসি পাস করেন। মাস্টার্স চলাকালে বাবার মৃত্যুতে পরিবারের দায়িত্ব নিতে ২০০০ সালে একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি শুরু করলেও শিক্ষার প্রতি আগ্রহের কারণে ২০০৩ সালে নাঙ্গলকোটের হেসাখাল বাজার উচ্চবিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। এরপর লাকসামের নরপাটি বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের পর বর্তমানে গণউদ্যোগ বালিকা উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ তিনি।

প্রাক্তন শিক্ষার্থী সৈয়দা আঞ্জিরুন, এখন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজে অনার্স শেষ বর্ষে পড়ছেন। তিনি বলেন, ‘রনজিৎ স্যার শুধু পাঠ্যবই নয়, জীবনের সঙ্গে শিক্ষাকে যুক্ত করতেন। তিনি গণিত ও বিজ্ঞান পড়াতেন এবং সবকিছুই এমন সাবলীলভাবে বোঝাতেন যে তা আমাদের হৃদয়ে গেঁথে যেত। স্যার বলতেন, “কেবল পাঠ্যবই পড়ে নয়, জীবন ও প্রকৃতি থেকে জ্ঞান আহরণ করো। জীবনে ব্যর্থতা আসবেই, কিন্তু তার থেকে শিখতে হবে এবং এগিয়ে যেতে হবে, সবচেয়ে বড় কথা হলো, ভালো ফল করার চেয়ে ভালো মানুষ হও।” স্যারের কথাগুলো সব সময় মেনে চলি।

ফাতেমা নামের প্রাক্তন শিক্ষার্থী বলেন, ‘একসময় আমি যেকোনো প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে ভয় পেতাম। কিন্তু স্যার আমাকে উৎসাহ দিয়েছেন, “ভুল করলে সমস্যা নেই, চেষ্টা না করাটাই আসল ভুল।” তখন থেকে আমি যেকোনো কাজ করতে আত্মবিশ্বাস পাই।

শহীদ মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ এমবিবিএস পাস করা হাজেরা খানমের প্রিয় শিক্ষক রনজিৎ দাশ। তিনি বলেন, ‘রনজিৎ স্যার আমার পথপ্রদর্শক। স্যার আমাকে শুধু বইয়ের পাঠই শেখাননি, জীবনের পাঠও শিখিয়েছেন।’
রনজিৎ চন্দ্র দাশ ‘মতামত বাক্স’ স্থাপন করে শিক্ষার্থীদের মতপ্রকাশের সুযোগ দেন। পাশাপাশি প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা, নিয়মানুবর্তিতা, শৃঙ্খলা, জবাবদিহি ও শিক্ষক-অভিভাবক-শিক্ষার্থীর সমন্বিত ভূমিকার মাধ্যমে তিনি গণউদ্যোগ বালিকা উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজের পরিবেশ আমূল পরিবর্তন করেছেন। নাঙ্গলকোটের উরুকচাইল গ্রামের নূরজাহান আক্তার-বাবাহারা, মানসিক ভারসাম্যহীন মায়ের মেয়ে।

মাথার ওপর ছাদটুকুও ছিল না তার। ভবিষ্যৎ যখন তার ঘোর অন্ধকারে ঢাকা, ঠিক তখনই এগিয়ে আসেন রনজিৎ স্যার। পড়াশোনার দায়িত্ব নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থাও করেন তিনি। বর্তমানে সপ্তম শ্রেণিতে পড়া নূরজাহান বলে, ‘স্যার আমাকে আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছেন। আমি পড়াশোনা করে স্যারের স্বপ্ন পূরণ করতে চাই।’ জানা গেছে, রনজিৎ চন্দ্র দাশ শিক্ষার্থীদের জন্য নীরবে কাজ করেছেন, এমন অসংখ্য মানবিক ঘটনা আছে স্যারের জীবনে। প্রতিবছর এসএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণের সময় অনেক দরিদ্র শিক্ষার্থীর ফি তিনি পরিশোধ করেন। দশম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী জানায়, ‘স্যার দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য একটি বিশেষ তহবিল তৈরি করেছেন। নিজের বেতনের কিছু অংশও সেখানে দেন এবং অন্য শিক্ষকদের সাহায্য নেন। সবকিছু গোপনে করেন। আমার মতো অনেক শিক্ষার্থী স্যারের সাহায্যে পড়াশোনা করছে।’
আপনার জীবনের সবচেয়ে বড় সার্থকতা কোথায়—প্রশ্নের জবাবে রনজিৎ চন্দ্র দাশ বলেন, ‘আমার শিক্ষার্থীরা আমাকে ছাড়িয়ে যেতে পারবে যেদিন, সেদিনই তো আমার শিক্ষকজীবন সার্থক হবে।’

আবদুর রহমান, কুমিল্লা

Scroll to Top