মো. আলাউদ্দিন
প্রধান শিক্ষক
আলিনগর বালিকা উচ্চবিদ্যালয়, গোমস্তাপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ
প্রধান শিক্ষক মো. আলাউদ্দিনকে নিয়ে লেখার জন্য প্রথমে দেখা করি গোমস্তাপুর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. মুসাহাক আলীর সঙ্গে। কেননা তাঁকে শত শত প্রধান শিক্ষককে নিয়ে কাজ করতে হয়। মো. আলাউদ্দিন সম্পর্কে মো. মুসাহাক আলী বলেন, চাকরিজীবনে অসংখ্য প্রধান শিক্ষককে নিয়ে কাজ করতে হয়েছে তাঁকে। তাঁদের মধ্যে মো. আলাউদ্দিন সেরা প্রধান শিক্ষকদের মধ্যে অন্যতম। একজন আদর্শ প্রধান শিক্ষকের মধ্যে যেসব গুণ থাকা দরকার, সবই তাঁর মধ্যে আছে, ছাত্রীদের সঙ্গে সরাসরি ও মুঠোফোনে কথা বলে জানা গেল, তিনি ভালো শিক্ষকের চেয়েও বেশি কিছু। বন্ধুর মতো, বাবার মতো, যেন মাথার ওপর বটবৃক্ষের ছায়া। বর্তমান ও প্রাক্তন ছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলার সময় বোঝা গেল, সবার কাছেই স্যার ভীষণ প্রিয়। তাঁর প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে কারও মুখেই দ্বিধা বা সংকোচ ছিল না। সবাই সাবলীলভাবে উচ্ছ্বাস নিয়ে বলে যাচ্ছিল। প্রায় সবার অভিন্ন অনুভূতি, ‘স্যারকে নিয়ে যতই বলি, কম হয়ে যায়। তাঁর গল্প শেষ করার মতো নয়।
মো. আলাউদ্দিন স্যার প্রিয় শিক্ষকের সম্মাননার জন্য মনোনীত হওয়ার খবর পেয়েই স্কুলে ছুটে এসেছেন প্রাক্তন ছাত্রী মোছা. রায়হানা পারভীন। চেহারায় খুশির ঝিলিক ঝরে পড়ছিল। তিনি বলেন, ‘ব্যক্তিগত বা পারিবারিক যেকোনো সমস্যায় ছাত্রীদের প্রথম ভরসা স্যার। যেকোনো ছাত্রী নির্দ্বিধায় তাঁর সঙ্গে কথা বলতে পারে। স্যার মনোযোগ দিয়ে শোনেন, সমাধানের চেষ্টা করেন। প্রয়োজনে শাসন করেন, আবার মেয়ের মতোই আদর করেন। পিছিয়ে পড়া ও দরিদ্র মেয়েদের প্রতি তাঁর খেয়াল সব সময় বেশি। কারও কেডস কেনার সমস্যা, কারও স্কুলড্রেস পুরোনো হয়ে গেছে—সব সমস্যার সমাধান তিনি নিজেই করেন।
ক্লাসে কোনো ছাত্রীকে ক্লান্ত বা বিষণ্ন দেখলে পরে আলাদাভাবে ডেকে মাথায় হাত বুলিয়ে খোঁজ নেন। প্রয়োজনে নিজের পয়সায় চিকিৎসার ব্যবস্থাও করেন। আর অদম্য মেধাবী গরিব ছাত্রীরা তাঁর বিশেষ নজরে থাকে। বিনা মূল্যে অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের বই-খাতা, এমনকি যাতায়াত খরচ পর্যন্ত দেন তিনি। শুধু তা-ই নয়, এসএসসি পাসের পরও তাঁদের উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি নিজে উদ্যোগ নেন।
এবার এসএসসিতে জেলার সর্বোচ্চ নম্বর (১২৬৪) পাওয়া আসিফা তাসনিম মুঠোফোনে জানায়, ‘স্যার শুরু থেকেই আমাকে টার্গেট করেছিলেন—এবার সর্বোচ্চ নম্বর পেতেই হবে। আমি মাঝেমধ্যে আস্থা হারালেও স্যার হারাননি। বাড়ি এসে সাহস দিতেন, দৃঢ়ভাবে বলতেন, “অবশ্যই তুমি পারবে”।
আসিফার মতে, নিজের সাফল্যের চেয়ে স্যারের আনন্দই তার কাছে বড়। ‘স্যার আমাদের আগলে রাখেন বটগাছের ছায়ার মতো। তাঁর ভালোবাসার ছায়ার নিচে আজীবন থাকতে চাই।’ শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী এবং এই বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রী সাবিয়া আফরিন বলেন, ‘বাবা সামান্য চায়ের দোকানদার, এমন পরিবার থেকে উঠে এসে আজ আমি এখানে—সবই স্যারের অবদান। জীবনে যা ভালো শিখেছি, সবই তাঁর কাছ থেকে। স্যারের সবচেয়ে ভালো দিক ছিল, তিনি নতুন কিছু শিখলেই আমাদেরও শেখাতেন। কখনো অ্যাসেম্বলিতে, কখনো ক্লাসে সবাইকে জানাতেন।’
এবার গোল্ডেন জিপিএ-৫ পাওয়া অদম্য মেধাবী সারমিন খাতুন বলেন, ‘স্যার আমাকে বিনা খরচে নিজে পড়িয়েছেন, বাড়ি থেকে যাতায়াতের ভাড়া, বই-খাতা, এমনকি স্কুলড্রেস পর্যন্ত স্যারই কিনে দিতেন। তাঁর কারণেই আমি আজ এ ফল করতে পেরেছি। স্যারের প্রতি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব।
প্রধান শিক্ষকের কক্ষে ঢুকতেই দেখি, তিনি ডাস্টার হাতে সপ্তম শ্রেণির ক্লাস নিতে বের হচ্ছেন। আমি পিছু নিলাম। পরিচিত হওয়ার পর শিক্ষার্থীদের জানালাম—তোমাদের হেডস্যার প্রিয় শিক্ষক সম্মাননা পাচ্ছেন। সঙ্গে সঙ্গেই তুমুল হাততালি, যেন থামতেই চায় না। হেডস্যার সম্পর্কে কেউ কিছু বলতে চাও কি না বলতেই দেখা গেল, ঘরভর্তি শিক্ষার্থীর অধিকাংশই হাত তুলেছে। দু–একজনের কাছ থেকে শুনলাম তাদের অভিজ্ঞতা। একজন বলল, স্যার অভিনব কায়দায় শিখিয়েছিলেন বাংলা বানানে ‘ন’ ও ‘ণ’-এর ব্যবহার, যা মনে গেঁথে আছে।
আনোয়ার হোসেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ