জগদীশ চন্দ্র রায়
প্রধান শিক্ষক
সুব্রত খাজাঞ্চী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চিরিরবন্দর, দিনাজপুর
মোটরসাইকেলে চেপে বিদ্যালয়ের উদ্দেশে ছুটছেন প্রধান শিক্ষক। পথে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের সঙ্গে দেখা হলেই থেমে কুশলবিনিময়, বিদ্যালয়ের ভালো–মন্দ, সন্তানের পড়ালেখা ও স্বাস্থ্যের খবর নিয়ে আবারও ছুটছেন। বিদ্যালয়ে পৌঁছানোর আগেই জেনে যান কোনো শিক্ষার্থীর বিদ্যালয়ে না আসা, অসুস্থতা বা বেড়াতে যাওয়ার খবর। আবার স্কুল ছুটির পরও বিদ্যালয়ে অনুপস্থিতির সংখ্যা নিয়ে অন্য শিক্ষকদের সঙ্গে আলাপ করেন, অভিভাকদের মুঠোফোনে খোঁজ নেন, অনেক সময় সশরীর বাড়িতে গিয়েও হাজির হন। সন্তানদের বিদ্যালয়ে পাঠাতে অভিভাবকদের এভাবেই উদ্বুদ্ধ করে যান তিনি।
এক দশক ধরে এই মহতী কাজ করে সফলতা পেয়েছেন প্রধান শিক্ষক। ওই এলাকায় এখন শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার শূন্যের কোঠায়। বিদ্যালয়ে ব্যতিক্রমী পাঠদান, খেলাধুলা ও নির্মল বিনোদনের পাশাপাশি সৌন্দর্যবর্ধন, বৃক্ষরোপণ, শিশুবান্ধব পরিবেশসহ নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
এরই মধ্যে বিদ্যালয়ের সুনাম ছড়িয়ে গেছে সারা দেশে। গত এপ্রিলেই এটি দেশসেরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্বীকৃতি পেয়েছে। শিশুদের স্কুলমুখী করা আর বিদ্যালয়কে শিশুবান্ধব করতে যিনি বড় অবদান রেখেছেন, তিনি হলেন দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলার কুশলপুর গ্রামের সুব্রত খাজাঞ্চী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জগদীশ চন্দ্র রায়।
২০১১-১২ অর্থবছরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ‘বিদ্যালয়বিহীন গ্রামে ১৫০০ প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন’ প্রকল্প নেয়। সেই প্রকল্পে ২০১৩ সালে এই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। পরের বছর, ২০১৪ সালে মাত্র ৩৩ জন শিক্ষার্থী নিয়ে শুরু হয় ক্লাস। তখনই প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পান জগদীশ চন্দ্র রায়।
জগদীশ চন্দ্র রায় বলেন, ‘উপবৃত্তির আওতায় না হওয়ায় তিন মাসের মাথায় ১১ জন স্কুল ছেড়ে চলে যায়। খারাপ লেগেছে কিন্তু হতাশ হইনি, থেমে যাইনি। স্থানীয় অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করি। নির্দিষ্ট সময়ের পরও বিদ্যালয়ে থেকে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বাড়াতে বাগান করাসহ নানা কার্যক্রম শুরু করি। ধীরে ধীরে সুফল পেতে শুরু করি। মাত্র ১০ বছর শেষে বিদ্যালয়ে এখন শিক্ষার্থীসংখ্যা ৩২০। আশপাশের অন্তত ৫-৬ গ্রামের শিক্ষার্থীরা পড়তে আসছে এখানে।’
স্থানীয় অভিভাবক ও শিক্ষকদের সহযোগিতায় বিদ্যালয়টিকে মনের মতো করে সাজিয়েছেন জগদীশ চন্দ্র। প্রধান ফটক দিয়ে প্রবেশ করতেই ইট বিছানো পথের দুই পাশে ঝাউগাছের সারি। বিদ্যালয়প্রাচীর, ভবনের দেয়ালের উভয় পাশ এমনকি ভবনের ছাদেও আঁকা হয়েছে বিভিন্ন ফুল, ফল, পশুপাখি, বিশিষ্ট ব্যক্তি, সৌরজগৎ, মানচিত্রের ছবি। প্রতিটি ছবির পাশে বিষয়বস্তুর নাম লেখা হয়েছে বাংলা ও ইংরেজিতে। দেয়ালগুলো যেন একেকটি বইয়ের পাতা হয়ে ধরা দিয়েছে শিক্ষার্থী ও দর্শনার্থীদের কাছে।
১৯৯৯ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত বিষয়ে স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন জগদীশ চন্দ্র রায়। এরপর যোগ দিয়েছেন শিক্ষকতা পেশায়। পড়ানোর কাজটি করেন যত্নের সঙ্গে। এ জন্য বিদ্যালয়ে রেখেছেন ইলেকট্রনিক ম্যাজিক স্লেট, বর্ণমালার বাড়ি-গাড়ি, কাঠ ও প্লাস্টিকের খেলনা বর্ণমালা, সংখ্যা, পাজল বই, বিজ্ঞান বক্স, রং চেনার জিওমেট্রিক স্টিকার, ছবি আঁকার সামগ্রী, বিল্ডিং ব্লকস, চাকাযুক্ত খেলনা ইত্যাদি। প্রতি বৃহস্পতিবার শিক্ষার্থীদের নিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। স্থানীয় উদ্যোগে সংগীত ও চারুকারুবিষয়ক দুজন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
জগদীশ স্যারের প্রাক্তন ছাত্র মিঠুন চন্দ্র বলেন, ‘আমরা অনেকে প্রাথমিকের পর অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্যারের কাছে গণিত শিখেছি। স্যার এত ভালোভাবে বোঝাতেন যে এখনো গণিতে কোনো সমস্যা হয় না।
জগদীশ চন্দ্র জানান, ২০১৭ সালে প্রথমবার সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল ১৫ জন। তাদের প্রত্যেকেই জিপিএ-৫ পেয়েছে। সেবার ২ জন সাধারণ গ্রেডে এবং ১ জন ট্যালেন্টপুলে বৃত্তিও পেয়েছে। শুধু পড়ালেখা নয় ২০১৭ সালে ফুটবল টুর্নামেন্টে জেলা পর্যায়ে রানার্সআপ হয় বিদ্যালয়টি।
এই প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘প্রাথমিক বিদ্যালয় হলো শিক্ষার্থীদের ভিত্তি গড়ার জায়গা। আমরা স্কুল ও শিক্ষার্থীদের জন্য বেশি সময় দিয়েছি, স্থানীয় লোকজনের সহযোগিতাও পেয়েছি। তাই শিশুদের স্কুলের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়েছে। এ গ্রামে ঝরে পড়ার হার এখন শূন্য। তবে শিক্ষিত সমাজ গড়তে প্রাথমিক শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত মানুষের জীবনমানও উন্নত করা দরকার।
রাজিউল ইসলাম, দিনাজপুর