পারভীন আক্তার
সাবেক প্রধান শিক্ষক
গভ. মডেল গার্লস হাইস্কুল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া
বছর বিশেক আগেও বিদ্যালয়ে মেয়েদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে আলোচনা খুব কম হতো। তখন একজন শিক্ষক শুধু পাঠ্যবই নয়, বরং শরীরচর্চা, খেলাধুলা, সুস্বাস্থ্য, মাসিক ও যৌনস্বাস্থ্য সম্পর্কে খোলাখুলি আলোচনা শুরু করেন। তিনি নতুন পথ দেখিয়েছিলেন। তিনি শাসনও করতেন, আদরও করতেন। তাঁর উদ্ভাবনী চিন্তা ও নিষ্ঠার ফলে বিদ্যালয়ের মেয়েদের পরিবেশ হয়ে উঠেছিল স্বাস্থ্যকর ও প্রেরণাদায়ী। এতে ছাত্রীদের আত্মবিশ্বাস ও উৎসাহ বেড়ে গিয়েছিল এবং পুরো বিদ্যালয়ের পরিবেশ বদলে গিয়েছিল। বলছি পারভীন আক্তারের কথা। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার গভ. মডেল গার্লস হাইস্কুলের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের বিষয়ে ওপরের কথাগুলো তাঁর সহকর্মী, বর্তমান ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীরাই বলেন।
পারভীন আক্তার ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহরের কান্দিপাড়ার বাসিন্দা ও এ এস এম বাদলের স্ত্রী। তাঁর তিন মেয়ে ও এক ছেলে। পারভীন আক্তার ১৯৭৮ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাবেরা সোবহান সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি, ১৯৮০ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ১৯৮২ সালে একই কলেজ থেকে ডিগ্রি ও সার্টিফিকেট কোর্স শেষ করেন। এরপর ১৯৮৪ সালের ১ জানুয়ারি গভ. মডেল গার্লস হাইস্কুলে শারীরিক শিক্ষার শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ২০১৬ সালে তিনি সহকারী প্রধান শিক্ষক এবং ২০২০ সালে প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতি পান। ৩৮ বছর সরকারি শিক্ষাজীবন শেষে ২০২২ সালের ১৫ ডিসেম্বর তিনি অবসরে যান। তিনি দীর্ঘদিন ধরে ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করছেন, এখন তাঁর চিকিৎসা চলছে।
পারভীন আক্তার বলেন, শিক্ষার্থীরা ব্যক্তিগত বিষয়ও তাঁর সঙ্গে শেয়ার করত। বয়ঃসন্ধিকালে কেউ ভুলভাবে কোনো সম্পর্কের সঙ্গে জড়ালে তিনি সেটি বোঝাতেন। এ ছাড়া বিদ্যালয়ের ভালো ফল ও সুনাম বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সংস্কৃতি, খেলাধুলা, চিত্রাঙ্কন, আবৃত্তি, বিতর্ক, শারীরিক শিক্ষাসহ সব সহ-শিক্ষাকার্যক্রম অবদান রাখে। কারণ, এসবের কারণে শিক্ষার্থীরা উৎফুল্ল থাকে এবং পড়াশোনায় বেশ মনোযোগী হয়। অন্যদিকে যেসব ছাত্রী আর্থিক সমস্যায় থাকত, বেতনের টাকা থেকে গোপনে অনেক শিক্ষার্থীকে সহায়তা করতাম।
পারভীন আক্তার বলেন, আমি মুখস্থবিদ্যায় বিশ্বাসী নই। যতক্ষণ না তারা বুঝত, ততক্ষণ আমি পড়া বোঝাতাম। আমি বিদ্যালয়ে শারীরিক শিক্ষার শিক্ষক ছিলাম। বিদ্যালয়ের মাঠে খেলাধুলায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সময় কাটাতাম। তিনি গর্ব করে বলেন, ‘আমার ছাত্রী মাইমনা মনি জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, নওরীন সুলতানা লালমনিরহাটের পিটিআইয়ে শিক্ষক, শের-এ-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক তৌফিকা ইসলাম বর্তমানে জাপানে পিএইচডি ডিগ্রি করছে। আরও অনেকে দেশ-বিদেশে রয়েছে। তাদের নিয়ে আমি গর্বিত।
বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী লালমনিরহাট পিটিআইয়ের পরীক্ষণ বিদ্যালয়ের শিক্ষক নওরীন সুলতানা বলেন, ‘পারভীন ম্যাডামই প্রথম আমাদের শিখিয়েছিলেন যে প্রশ্ন করে ও অংশগ্রহণের মাধ্যমে অনেক কিছু শেখা যায়। আগে মেয়েদের অনেক বিষয় লজ্জা, ভয় বা সামাজিক ট্যাবুর কারণে আলোচনায় আসত না। কিন্তু ম্যাডাম সেই বাধা ভেঙেছিলেন। তিনি মফস্সলের মেয়েদের বুঝিয়েছিলেন, অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়া কতটা জরুরি। আমি যখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি, তখন তাঁর নেতৃত্বে বিদ্যালয়ে বিনা মূল্যে স্যানিটারি ন্যাপকিন বিতরণ করা হয়েছিল। এই সাহসী ও মানবিক উদ্যোগ শুধু স্কুলের পরিবেশ বদলায়নি, আমাদের আত্মবিশ্বাস গড়ার জন্যও এক শক্ত ভিত্তি তৈরি করেছিল। তিনি ছিলেন আমাদের অভিভাবক, পরামর্শদাতা ও পথপ্রদর্শক।
বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী অনিতা ইসলাম বলেন, ‘পারভীন ম্যাডাম খুব বন্ধুসুলভ ছিলেন।
শিক্ষক আমিনুল ইসলাম বলেন, তিনি শরীরচর্চার শিক্ষক ছিলেন এবং মেয়েদের খেলাধুলার জন্য প্রস্তুত করতেন। বিদ্যালয়ের জন্য অনেক পুরস্কার জিতেছেন। শুধু খেলাধুলা নয়, শ্রেণিকক্ষে পড়াতেও তিনি ছিলেন খুব দক্ষ।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুল লতিফ বলেন, তিনি খুব ভালো ও সবার সঙ্গে আন্তরিক ছিলেন। এই স্কুলে তাঁর মতো জনপ্রিয় শিক্ষক আর কেউ ছিলেন না।
শাহাদৎ হোসেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া